ব্রাডলি
বার্টের প্রাচ্যের রহস্য নগরী ঢাকা উনিশ শতকে কেমন ছিল দেখতে? ইসলাম খাঁর ঢাকার জৌলুস তখন ক্ষয়িষ্ণু। কোম্পানি আর ব্রিটিশ রাজের
শাসন। ঢাকার সেকালের চেহারা দেখতে আমাদের নির্ভর করতে হয় ইউরোপীয় চিত্রকরদের
ওপর। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আসে কোম্পানির কর্মকর্তা চার্লস ডয়েলির নাম। তার স্কেচগুলো ঢাকা ও পাশের এলাকার
অনেক স্থাপনাকে চিত্রিত করেছিল। তিনি ছাড়াও আরো কয়েকজন শিল্পী ঢাকাকে এঁকেছেন। তবে সবার আঁকায় দুটো বিষয় কম-বেশি বারবার
এসেছে—বুড়িগঙ্গা
নদী আর লালবাগ কেল্লা।
ফ্রেডরিখ উইলিয়াম আলেকজান্ডার ডি ফ্যাবেক জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। পিতা ফার্দিনান্দ উইলিয়াম ভন ফ্যাবেক ছিলেন জার্মান এবং মা লেইডে মিউলেন্স ডুপ্লান্টিস বেলজিয়ান। বাবা শিক্ষাবিদ আর মা চিত্রশিল্পী। দুজনেরই ছিল শিল্পের প্রতি দরদ। ডি ফ্যাবেক পড়াশোনা করেন প্যারিসে। এডিনবার্গের রয়েল কলেজ অব সার্জন থেকে ডিগ্রি নেন। ১৮৫৭ সালে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে আবেদন করলে তা মঞ্জুর হয়। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে মাদ্রাজে নিযুক্ত হন। ঠিক পরের বছর তাকে পাঠানো হয় বাংলায়। ১৮৬৯ সালে সার্জন, ১৮৭৩ সালে সার্জন মেজর এবং ১৮৮২ সালে ব্রিগেট সার্জন পদে উন্নীত হন। ১৯১২ সালের ৫ মে তিনি ইতালিতে মারা যান।
মায়ের সূত্রেই শিল্পের কাছে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন ডি ফ্যাবেক। তাছাড়া বাবা ও মায়ের সাংস্কৃতিক ভিন্ন পরিচয় তাকে প্রস্তুত করেছিল ভিন্ন সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে। ফলে তিনি যখন ভারত ও বাংলাকে আঁকতে বসেন, তাকে অন্য কেউ হয়ে নয়; স্থানীয় কোনো চোখেই যেন দেখেছেন। তার এ স্বভাবের কারণেই এখানকার স্থাপত্য ও শিল্পকলাকে অনুভব করতে পেরেছেন। তার আঁকা ছবিগুলো সমকালীন ঢাকার চালচিত্র তুলে ধরে। খুব সম্ভবত ছবিগুলো তিনি জয়পুর স্কুল অব আর্টে থাকার সময় এঁকেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এর পরিচালক পদেও উন্নীত হন তিনি। জয়পুর প্রদর্শনীর আয়োজন নিয়েও পরিকল্পনা ছিল তার। জয়পুরে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই ডি ফ্যাবেক ব্যাপক ভ্রমণ করতে থাকেন। আর আঁকতে থাকেন নিজের মতো করে। শিল্পে তার গভীর দখল দেখে মহারাজা রাম সিং তাকে নয়া প্রতিষ্ঠিত আর্ট স্কুলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। অর্থাৎ রেসিডেন্সি সার্জনের পাশাপাশি তিনি এখন আর্ট স্কুলেরও পরিচালক। মহারাজা তাকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন ইউরোপীয় ধাঁচের শিক্ষা-দীক্ষা না দেন ছাত্রদের। তার বদলে জয়পুর ও ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা সম্পর্কেই অবহিত করেন। জয়পুরেই ১৮৬৮ সালে মহারাজা ডি ফ্যাবেককে নতুন বাগান তৈরিতে নিযুক্ত করেন, যার নাম রাম নিবাস। তার সে সৃষ্টিকর্মে মিলিত হয়েছে পশ্চিমা ও ভারতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন। একাকার হয়ে গেছে ফরাসি, জার্মান ও ইংরেজ ঘরানার প্যাটার্ন। ফ্যাবেক রাজপুত, মোগল ও প্রথাগত হিন্দু স্থাপত্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। জয়পুরে মেয়ো হসপিটাল ও আজমিরে মেয়ো কলেজে তার সে ধারণার ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে। মহারাজা রাম সিংয়ের সময় আরো কিছু স্থাপত্যগত নিদর্শন রয়েছে। তার মৃত্যুর পর নতুন মহারাজা হন দ্বিতীয় মাধো সিং (১৮৮০-১৯২২)। তিনি অর্ধ সমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ডি ফ্যাবেককেই নির্বাচিত করেন। ফ্যাবেক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিকতা মেশানোর ক্ষেত্রে।
ফ্যাবেকের
চিত্রকর্মে উঠে আসে উনিশ শতকের ঢাকা, যখন একসময়ের প্রভাবশালী নগরীটি তার জৌলুস হারাতে বসেছে। ঢাকা নিয়ে অন্তত চারটি চিত্রকর্ম পাওয়া যায় তার। একটা ছবিতে তিনি বুড়িগঙ্গা নদীকে এঁকেছেন। সেখানে ভেসে যাচ্ছে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌকা।
খুব সম্ভবত জায়গাটা লালবাগ দুর্গের পেছনের দিকে। চিত্রকর্মটি এঁকেছেন ১৮৬১ সালে। দ্বিতীয় চিত্রকর্মটি ঘাস ও লতাপাতায় ছাওয়া
এক বিধ্বস্ত মসজিদের। তৃতীয় চিত্রকর্মটি কোনো এক নওয়াববাড়ির। সময়ের
ভারে যার ছাদটিও অবশিষ্ট নেই। ফ্যাবেক ধ্বংসাবশেষকে চিত্রিত করেছেন নিখুঁতভাবে। সর্বশেষ চতুর্থ চিত্রকর্ম বিধ্বস্ত পাঁচিলে গাছ গজিয়ে যাওয়া নওয়াব বাড়ির গেটের নিচ দিয়ে মানুষ হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য, যা ক্রমক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক
পরিস্থিতিকেই তুলে ধরে। এ ছবিগুলো ১৮৬৩
সালে আঁকা। এর বাইরে বাঙালি
নারীদের নিয়ে কয়েকটি চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন তিনি। কখনো অলংকারে সজ্জিত, কখনো লাল শাড়ি পরিহিত আবার কখনো সবুজ কাপড়। বাঙালি তকমা থাকলেও খুব সম্ভবত উত্তর ভারতীয় নারীদের সঙ্গে মিলে যায়।
পেইন্টিংয়ের বাইরে স্কেচেও উঠে এসেছে উনিশ শতকের ঢাকা। এক্ষেত্রে চার্লস ডয়লির নামটিই সর্বাগ্রে চলে আসে। আরো একজনের নামও স্মরণ করা প্রয়োজন, তিনি জর্জ চিনারি (১৭৭৪-১৮৫২)। ঢাকা নিয়ে জর্জ চিনারির আঁকা অন্তত তিনটি স্কেচের হদিস পাওয়া যায়। জর্জ চিনারি ১৭৭৪ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। লন্ডনের রয়েল একাডেমি স্কুলে পড়াশোনা করে ২২ বছর বয়সে ডাবলিনে যান এবং সমকালীন চিত্রশিল্পীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। ১৮০২ সালে তিনি লন্ডন ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমান। লন্ডনে ফেলে আসেন স্ত্রী মেরিঅ্যান ভিগনে ও তার দুই সন্তান। এখানে অবস্থান করেন ১৮২৫ সাল পর্যন্ত। ১৮২৫ সাল-পরবর্তী জীবন কাটিয়েছেন ম্যাকাওতে। তিনি চার বছর ঢাকায় ছিলেন—১৮০৮-১২। ঢাকাকে চিত্রিত করেছেন তার মতো করে। ভারতে পশ্চিমা ঘরানার চিত্রশিল্পীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন তিনি। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি দীর্ঘ সময় পোর্ট্রেট আঁকেন এবং তার মধ্য দিয়ে ভালো অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু খরচও নেহাত কম ছিল না। ক্রমে দারিদ্র্য এমনভাবে বাড়ল যে তাকে ম্যাকাওয়ের দিকে রওনা হতে হলো। ঢাকায় অবস্থানকালে ১৮০৮ সালের দুটি স্কেচের প্রথমটি বড় কাটরার গেট এবং দ্বিতীয়টি বুড়িগঙ্গা নদী। বড় কাটরার গেটে দেখা যায় এক ব্যক্তি হাতির পিঠে, এক ব্যক্তি ঘোড়ার লাগাম হাতে। পাশেই আরো কয়েকজন। পেছনে প্রাচীন ভবন। বুড়িগঙ্গার স্কেচটা আরো করুণ। জনৈক ব্যক্তি পানি নিচ্ছে, পেছনে কয়েকটি গরু অপেক্ষারত কিংবা রোদ পোয়াচ্ছে। নদীর পানিতে পড়ে আছে ভবনের ভাঙা দেয়াল। মোগল ও নবাবি আমলে থাকা জৌলুস যেন ধসে পড়ছে বুড়িগঙ্গার পানিতে।
জোহান
জোফানি আঠারো শতকের একজন বিখ্যাত জার্মান চিত্রশিল্পী। তার চিত্রকর্ম ছিল সমাজের উঁচুতলার মানুষের প্রতিচ্ছবি। তিনি ১৩ মার্চ ১৭৩৩
সালে জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন স্থপতির সন্তান। জোফানি রোগেনবার্গের চিত্রশিল্পী মার্টিন স্পায়ারের কাছে শিক্ষানবিশ ছিলেন। ১৭৫০ সালের দিকে তিন বছর শিক্ষানবিশ শেষে তিনি রোমে চলে যান। আইসেলিনের সঙ্গে তার ১০ বছরের সংসার
জীবন ব্যর্থ হয়। ভাগ্যের সন্ধানে ১৭৬০ সালে লন্ডনে চলে যান। জোফানির চিত্রকর্ম ১৭৬২ সালে সোসাইটি অব আর্টিস্টে প্রদর্শিত
হয়েছিল এবং অনেক প্রশংসাও পেয়েছিল। কিছুদিন পর তিনি শিল্পী
লর্ড বুটের জন্য কাজ করেছিলেন। ১৭৮৩ পর্যন্ত তিনি কখনো লন্ডন, ফ্লোরেন্স, মিলান বা কখনো রোমে
ঘুরেছেন এবং অনেকের সান্নিধ্যে এসেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন নিজের শিল্পী জীবন। তিনি ১৭৮৩-তে ভারতের উদ্দেশে
যাত্রা করেন। রাজাদের প্রতিকৃতি, রাজদরবারের আলোচনা সভার কথোপকথনের চিত্র ইত্যাদি ছিল জোফানির আঁকার বিষয়। তবে কিছু চিত্র ছিল এ ধারার বাইরে।
সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকাকেন্দ্রিক দুটি চিত্র। ১৭৮৭ সালে এঁকেছিলেন ‘লালবাগের দক্ষিণ
গেট’ ও
‘নারিন্দা ঘাট’। এ বিখ্যাত
দুটি চিত্রকে ঢাকার আর্ট একাডেমিকরা ল্যান্ডস্কেপ বলে অভিহিত করেছেন। তবে মজার ব্যাপার ২০১১ সালে চার্লস গ্রেগ ঔপনিবেশিক ভারত ও পশ্চিমে জোহান
জোফানির (১৭৩৩-১৮১০) কাজ নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে গবেষণা করেছেন। সে বছরই ডিসেম্বরে
গ্রেগ লালবাগের দক্ষিণ গেটের চিত্রটি শনাক্ত করেন। তখনই জানা যায় ১৭৮৭ সালে জোফানির আঁকা দুটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ঢাকার। নারিন্দার চিত্রটিকে পাশ্চাত্য শিল্প বিশেষজ্ঞরা এতদিন ভেবেছিলেন উত্তর ভারতের কোনো একটি স্থান। জায়গাটা যে ঢাকা বা
পূর্ববঙ্গের সেটা কখনো কারো কল্পনায়ও আসেনি। ১৮০০ সালের পরে জোহান জোফানি আর কোনো ছবি
আঁকেননি। তবে তার অঙ্কিত চিত্রগুলোর প্রদর্শনী এখনো লন্ডনের মিউজিয়ামে হয়। তার বিখ্যাত চিত্রগুলোর মধ্যে ‘ট্রিবুনাল’ ও"‘রিচ ফ্যামিলি’র
প্রতিকৃতি অন্যতম। জার্মান এ চিত্রকর তার
জীবনের শেষ সময় কাটিয়েছেন লন্ডনে। ১৮১০ সালে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।