মাধ্যমিক শিক্ষা

মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশ: ডিসেম্বর ০৬, ২০২৩

শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক পর্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে যথাযথ শিক্ষা প্রদান শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের ভিত গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য যোগ্য শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষকরা যেন সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারেন, এজন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের হার কমে এসেছে বলে সম্প্রতি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশের শিক্ষা খাতের জন্য মোটেও ইতিবাচক নির্দেশক নয়।

বণিক বার্তায় প্রকাশ, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পূর্বশর্ত ও শিক্ষা খাতের অন্যতম অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকের উপস্থিতিকে দেখা হয়। যদিও বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে দক্ষ ও যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার কমে আসছে বলে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। ২০১১ সালে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ শিক্ষকের হার ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি ছিল। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৬৮ শতাংশে। 

প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষক বলতে মূলত বিভিন্ন শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা কলেজ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া শিক্ষকদের বোঝানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষকদের যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে সনদ দেয়া হয়ে থাকে। ব্যানবেইসের প্রতিবেদনেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক হিসেবে মূলত ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড), ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন (বিপিএড), ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচার এডুকেশন (বিএজিএড), মাস্টার্স অব এডুকেশন (এমএড) অথবা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারীদেরই বিবেচনা করা হয়েছে। 

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলে। কারণ মাধ্যমিক  পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে না পারলে পরবর্তী সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও দুর্বলতা থেকে যায়। যে কারণে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে পাঠদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রশিক্ষণের সময় কঠিন বিষয় শেখানো এবং শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্য বিষয় আকর্ষণীয় করে তোলার কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করায় তা শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।  

বর্তমানে পুরনো দক্ষ শিক্ষকদের অবসর গ্রহণ ও নতুনদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ড (মাউশি) কর্মকর্তারা দাবি করছেন। তবে শিক্ষকদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিএড অর্জনের জন্য ছুটি না পাওয়া এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জটিলতা থাকায় শিক্ষকদের অনেকেই এ সনদ অর্জন করতে পারছেন না। ফলে মোট শিক্ষকের মধ্যে দক্ষ ও যথাযথ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হারও হ্রাস পাচ্ছে। 

বস্তুত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত না করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে শিক্ষাবিদরা দাবি করছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে পরিকল্পনা বা শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন প্রসঙ্গে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার উন্নয়ন আশা করা যায় না। এছাড়া সম্প্রতি যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে এর লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষকদের ভালোভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। দেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষকদের এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেয়া কারো কারো জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে বলে জানা গেছে।

এছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের মানহীন প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি কতিপয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে মোটা টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনোমতে পরীক্ষা দিয়ে বিএড-এমএড সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার  বিস্তর অভিযোগও রয়েছে। এতে অর্থের বিনিময়ে সনদ মিললেও যথাযথভাবে শিক্ষকরা প্রশিক্ষিত হচ্ছেন না। সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমেও এর প্রভাব পড়ছে।

উন্নত দেশের শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এজন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষা খাতে বরাদ্দসহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গুরুত্ব পায়। শিক্ষকতার মতো পেশায় ভালো করতে হলে এবং শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। অথচ এ প্রশিক্ষণই এখন সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছে। ফলে দেশের বেহাল শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির স্বার্থে শিক্ষকরা যেন উন্নত প্রশিক্ষণ পান তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষেরও প্রয়োজনে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। 

প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকের অভাবে শিক্ষকরা দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পান না। আর অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকের কারণে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনিতেও শিক্ষা ব্যবস্থার যে অসংগতিগুলো দৃশ্যমান, তাতে শিক্ষা খাতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া আর কিছুদিন পরই দেশে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ বিদ্যমান কাঠামোয় যেভাবে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন, তাতে নতুন শিক্ষাক্রমের ক্ষেত্রেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেন যথাযথ প্রশিক্ষণ পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা খাত নিয়ে সরকারের যে আন্তরিকতা রয়েছে, তাতে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য সরকারি টিচার্স টেনিং কলেজগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি কলেজগুলোয় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্কুলগুলো থেকে শিক্ষকরা যেন প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পান সেটিও তদারকি করা প্রয়োজন। আমরা প্রত্যাশা করব, মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ডের (মাউশি) কঠোর ভূমিকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিকতা কাম্য।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫