সিওপিডি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ

সিওপিডি ভয় নয় জয় করুন

প্রকাশ: নভেম্বর ২৭, ২০২৩

ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্‌নূর

সিওপিডি। কিছুদিন আগেও রোগের নাম আমাদের কাছে খুব পরিচিত ছিল না। বক্ষব্যাধি বলতে আমরা বুঝতাম অ্যাজমা বা হাঁপানি, নিউমোনিয়া, টিবি বা যক্ষ্মা, ব্রংকাইটিস রোগগুলোকে। হাল আমলে অবশ্য সিওপিডি নামের বুকের অসুখটি অনেকের কাছেই আর অচেনা নয়।

সিওপিডির পূর্ণাঙ্গ রূপ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। রোগটির নামের মধ্যেই এর পরিচিতি বহুলাংশে প্রকাশিত হয়েছে। ক্রনিক অর্থ দীর্ঘমেয়াদি, অবস্ট্রাকটিভ মানে বাধাদানকারী পালমোনারি ডিজিজ মানে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। সহজ কথায়, সিওপিডি এক ধরনের জটিল দীর্ঘমেয়াদি শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টিকারী রোগ।

সিওপিডি রোগের প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে:

            শাসকষ্টবিশেষত সামান্য পরিশ্রম করলেই হাঁপিয়ে যাওয়া। এই শ্বাসকষ্ট সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে।

            শ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো বা শাঁ শাঁ শব্দ হওয়া।

            বুকে চাপ বোধ হওয়া।

            ঘন ঘন কাশি এবং অতিরিক্ত শ্লেষ্মা বা কফ নির্গত হওয়া।

            ধীরে ধীরে দুর্বল হওয়া দৈনন্দিন কাজে অক্ষমতা তৈরি হওয়া।

সাধারণত বয়স্করা সিওপিডি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। ধূমপান বা সিগারেট খাওয়া অসুখের অন্যতম কারণ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। দেখা গেছে চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তি যিনি কমবেশি কুড়ি বছর ধরে দৈনিক গড়ে এক প্যাকেট সিগারেট সেবন করেছেন তার সিওপিডি হওয়ার আশঙ্কা এবং গৃহাভ্যন্তরে বায়ুদূষণ, ঘন ঘন ফুসফুসের সমস্যা রোগ বৃষ্টিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিরল ক্ষেত্রে জন্মগত কারণেও সিওপিডি হতে পারে।

সিওপিডির উপসর্গগুলো দেখে মনে হতে পারে এগুলো অ্যাজমা রোগের হবহু অনুরূপ। বাহ্যিকভাবে তা হলেও দুটি রোগের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। অ্যাজমায় রোগীর শ্বাসকষ্ট হয় বিরতি দিয়ে। মধ্যবর্তী সময়ে রোগী প্রায় স্বাভাবিক থাকে। সাধারণত কিছু অ্যালার্জি জাতীয় উত্তেজক পদার্থের সংস্পর্শে হাঁপানির উদ্রেক হয়। ফলে শ্বাসনালির সংকোচন হয় এবং কাশি দেখা দেয়। তবে শ্বাসকষ্ট কাশি সাময়িক এবং চিকিৎসায় পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব। পক্ষান্তরে সিওপিডিতে শ্বাসনালির যে সংকোচন হয় তা বহুলাংশে স্থায়ী এবং পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া দুষ্কর। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে।

সিওপিডি রোগটি নিরাময় করা না গেলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব। সিওপিডি রোগীরা প্রায় দীর্ঘদিন উপসর্গমুক্ত থাকতে পারে। সিওপিডি নিয়ন্ত্রণে প্রধান প্রথম প্রয়োজন ধূমপান নিবারণ করা। সব ধরনের সিগারেট, বিড়ি, হুঁকা সেবনও বন্ধ করতে হবে। অধুনা প্রচলিত ভেপিং বা -সিগারেটও একই রকম ক্ষতিকর এবং এটিকেও পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের বায়ুদূষণ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কলকারখানা, গাড়ি ইটভাটার ধোঁয়া প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশকে দূষিত করছে। ফলে সিওপিডির প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলছে। যেসব নারী বদ্ধ পরিবেশে লাকড়ি, কাঠ, খড়, পাতা ইত্যাদি জৈব জ্বালানি ব্যবহার করে চুলায় রান্না করেন, তারা চুলা থেকে নির্গত ধোঁয়ার প্রভাবে সিওপিডি রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নারীদের মধ্যে প্রচুর সিওপিডি রোগী বাড়ছে। এটা রোধকল্পে বিকল্প জ্বালানি এবং কম ধোঁয়া উৎপন্নকারীবন্ধু চুলা প্রচলন করা জরুরি।

সিওপিডি রোগ হয়ে গেলেই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বর্তমানে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এজন্য দ্রুত ধূমপান বর্জন, বায়ুদূষণ বোধ করাসহ যথাযথ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন শাক, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, শরীরচর্চা সিওপিডি রোগীকে বহুলাংশে সুস্থ রাখতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে যথা সময়ে টিকা গ্রহণ সিওপিডির তীব্রতা ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে আনতে পারে। শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পান ভবিষ্যৎ জীবনে তাকে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দান করে, যা সিওপিডি অন্যান্য জটিল ্যাধি থেকে তাকে রক্ষা করবে।

সিওপিডি রোগের উপসর্গের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে গেলে পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে রোগীর বহুলাংশে উপশম দেয়া সম্ভব। প্রক্রিয়ায় সমন্বিত বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শ্বাসতন্ত্রের পুনর্বাসন করা হয়।

বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুসারে বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ সিওপিডিতে ভুগছে। অথচ রোগটি প্রতিরোধযোগ্য। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের সচেতনতার মাধ্যমে মৃত্যু কমানো যায়। মনে রাখতে হবে, সিওপিডি মানুষের অবহেলা অসাবধানতার কারণে সৃষ্ট একটি রোগ। রোগটির প্রধান কারণ ধূমপান বায়ুদূষণ। একমাত্র ধূমপান বন্ধ করতে পারলে ৮০ শতাংশ সিওপিডি রোগ হ্রাস পাবে।

সিওপিডির দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো বায়ুদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে ৯০ শতাংশ মানুষ দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়। প্রতি বছর ৬৫ লাখ মানুষ বায়ুদূষণজনিত রোগে মারা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় আট লাখ মানুষের রোগে মৃত্যু হয়। ঢাকা শহরের বাতাসের দূষণের সূচক হলো ১৬০ বা এর ওপরে। সূচক যদি ৫০-এর নিচে থাকে সূচক বায়ুর সবচেয়ে ভালো মান নির্দেশ করে। যদি সূচক ৫০ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকে সেটা গ্রহণযোগ্য। সূচক ১০০-এর ওপর গেলে অগ্রহণযোগ্য এবং ১৫০ অতিক্রম করলে এটাকে কোনোভাবেই গ্রহণ করা যাবে না। বাংলাদেশের বায়ুদূষণ সূচকের উচ্চ মাত্রা আমাদের ফুসফুসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের সচেতন হওয়ার এখনই সময়। বাধা-বিপত্তিকে ভয় না পেয়ে, রোগ-ব্যাধিকে জয় করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক: পালমোনোলজিস্ট, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এবং যুগ্ম সম্পাদক বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫