সাক্ষাৎকার

মানবিক গুণাবলির শিক্ষাই অল্টারনেটিভ এডুকেশন

প্রকাশ: নভেম্বর ২৭, ২০২৩

অধ্যাপক মুজিব খান। বিকল্পধারার এক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সফল কারিগর। তিনি স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (সোডা), কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (কোডা) ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। ইউডায় দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মলিকুলার মেডিসিন অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিকস বিভাগ চালু করেন তিনি। শিক্ষা ব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার ভাবনার কথা শুনেছেন শফিকুল ইসলাম 

সোডা, কোডা ও ইউডা—ভিন্নধর্মী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শুরুটা জানতে চাই।

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি বুঝতে পারি আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি সে উদ্দেশ্য পূর্ণতা পায়নি। তখন রাজনীতি, সমাজ ও নানা বিষয়ে জড়িত ছিলাম। ভাবলাম কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। কেন এমন হলো? এ প্রশ্ন থেকেই মনে হলো নীতি-আদর্শ, সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ব্যবস্থাই হোক না কেন সেখানে যদি জ্ঞানী-গুণী মানুষ না থাকে, মানুষগুলো যদি ভালো না হয় তাহলে কোনো দল, ধর্ম বা দর্শন দিয়ে সমাজের পরিবর্তন করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এ রকম একটি ধারণা আমার মধ্যে জন্ম নেয়। শিক্ষা জীবন শেষে আমি নিজেই উদ্যোগ নিলাম যে যদি দশজন ছেলেমেয়েও মানুষ করতে পারি সেটি সমাজের জন্য বড় কিছু বয়ে আনবে। 

পরবর্তী সময়ে দেশের মেধাবী ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা শুরু করলাম বাংলাদেশ ছাত্র কল্যাণ সংস্থা নামে। আমার নিজের আয় দিয়েই শিক্ষার্থীদের সহায়তা করি। নিজের আয় দিয়ে যতটুকু পেরেছি শুরু করেছিলাম। ওষুধ ও ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে গবেষণার কাজও শুরু করি। এর ধারাবাহিকতায় কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান খাদ্য ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পও গড়ে তুলি। এগুলোর আয় দিয়েই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। এগুলো করার কারণ হলো ছাত্র কল্যাণ সংস্থা শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল কোনো পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে না। যখন আর্থিক সামর্থ্য বাড়ে তখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা মাথায় আসে। একটি সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম না হলে জ্ঞানী সমাজ বিনির্মাণের টার্গেট পূরণ হবে না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ভালো ফল, ভালো চাকরি ও আয়ের মনোবৃত্তি থাকে কিন্তু সেখানে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ঘাটতি কিছুটা হলেও থাকে। কারিকুলামে এর কোনো সংযোজন নেই। এটি করার জন্যই অল্টারনেটিভ সিস্টেম অব এডুকেশন চালু করি। যা সবার থেকে ভিন্ন। 

এ অল্টারনেটিভ এডুকেশন সিস্টেম আসলে কেমন? 

এখানে তিনটি স্তর। শিশু থেকে শুরু করে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত একটি স্তর, ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত একটি এবং আঠারোর পর উচ্চশিক্ষা স্তর। তিন স্তরের শিক্ষায় এমন একটি ব্যবস্থা রয়েছে সে যে বিষয়ে পড়বে সে বিষয়ে জ্ঞান অর্জন তো করবেই পাশাপাশি তার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মানবিক গুণাবলি ও সামাজিক রীতিনীতিগুলোও শিক্ষার মধ্যে থাকবে। এ শিক্ষাগুলো ছোটবেলা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত থাকা উচিত। বড় হওয়ার পর ধর্ম, রাজনীতি, দর্শন এ ধরনের বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসা উচিত। এমন চিন্তা থেকেই এ বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করা শুরু করি। সেই ধারাবাহিকতায়ই কোডা, সোডা প্রতিষ্ঠা। যখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট হয় তখন আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে পারিনি। ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন করি। ২০০২ সালে অনুমোদন পাই ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের। স্কুল-কলেজে যাদের টাকা আছে তারাই পড়তে পারে কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ যাদের টাকা নেই তারা কোথায় যাবে? এমন ভাবনা থেকে সমতা স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। আবার অনেকে আছে পড়াশোনায় ভালো না কিন্তু হাতে-কলমে ভালো কাজ পারে, টেকনিক্যাল দিকে তারা ভালো। তাদের জন্য টেকনিক্যাল স্কুলও রয়েছে। শুধু পড়াশোনার ও বইপত্রের বাইরেও আরো কিছু ফ্যাক্টর আছে সমাজে। খেটে খাওয়া ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী যদি শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে সমাজ এক শ্রেণীর কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলাম, তার শেষ পর্যায় হলো ইউডা। 

ইউডা কোন দিক থেকে আলাদা?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পথশিশুদের শিক্ষার আলো দেখিয়েছি। স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে পড়াশোনা শেষ করে তারা এখন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে পড়ছে। এখনো প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কয়েকজন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তিন স্তরের শিক্ষা নিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। সবাই খুবই ডিসিপ্লিনড। আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষক, শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে শিক্ষার্থীরা। 

আমরা প্রমাণ করেছি মধ্যম মানের ফলাফল নিয়েও মেধা-যোগ্যতায় ভালো অবস্থান তৈরি করা যায়। জ্ঞান সার্টিফিকেট দিয়ে পরিমাপ বা সীমাবদ্ধ করা যায় না। এখন বাংলা কেউ পড়ে না। পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে কিছু ভর্তি হয়, সেটা টার্গেট করে পড়ে না, শুধু পাবলিকে পড়ার জন্যই পড়ে। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলেছি বাংলায় যারা পড়বে আমি নিজে তাদের আর্থের জোগান দেব, তোমাদের টাকা দিতে হবে না। চাকরিও আমি দেব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ রয়েছে। এটি জাতীয় সংসদের মতো। ছাত্র প্রতিনিধিসহ সব বিভাগের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চেয়ারম্যান, ভিসি, রেজিস্টার মিলে এ সংসদ গঠিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ইস্যু সংসদের মতো নটিফাই করে জবাবদিহি করা হয়। শিক্ষার্থীদের কোনো প্রয়োজন এ সংসদের মাধ্যমে বলে। এটিও আমাদের একটি অর্জন। 

মলিকুলার মেডিসিন অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিকস বিভাগ চালুর পরিকল্পনা এল কীভাবে?

আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে। মানুষের কল্যাণে বিশ্বে নতুন যেসব সাবজেক্ট আসে আমরা সেসব নিয়ে কাজ করি। মলিকুলার মেডিসিন ও বায়োইনফরমেটিকস তার একটি। সামনের দিনে দেখবেন এতো বেশি ওষুধ থাকবে না। জেনেটিকস মেডিসিন বা বায়োইনফরমেটিকসের মাধ্যমে জিন থেরাপি করবে বা সেল এক্সচেঞ্জ করবে। রোগটি এখন যেভাবে আমরা নির্ণয় করি ওখানে তথ্য দেবে আপনার কোন সেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেটি কতটুকু এবং এটি প্রতিস্থাপন করতে পারে অন্য কোন সেল—এ সিকোয়েন্সিং যদি করা সম্ভব হয় তাহলে জেনেটিকস এক্সচেঞ্জ করা সম্ভব হবে। এটাকেই মলিকুলার চেঞ্জ বলা হয়। বিশ্ববাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। অনেক টাকা বেতনও দেয় তারা। আমাদের ছেলেমেয়েদের নতুন এ বিষয় সম্পর্কে পড়াশোনা করা উচিত। 

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা খাতে কোন ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন?

আমার স্বপ্নই ছিল জ্ঞানী-গুণী মানুষ শিক্ষার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসুক। তবে এ মানুষ তৈরিতে পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন যেমন রয়েছে, তেমন সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষারও প্রয়োজন। এই দুই শিক্ষার সমন্বয় দরকার। সে অনুযায়ী আমরা মডেল প্রতিষ্ঠান ইউডা, কোডা, সোডা করেছি। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়েও ভালো শিক্ষক প্রয়োজন। মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন শিক্ষকরা যদি পড়ান তাহলে সাবজেক্ট বা অন্য অবকাঠামো এসব কোনো প্রতিবন্ধকতা না। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখেছি উচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা খাতকে পরিচালনার। শুধু শিক্ষকই নয়, শিক্ষকদের যারা পরিচালনা করেন তাদেরও উচ্চ মানবিক গুণসম্পন্ন হতে হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫