বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প

মজুরিতে খুব নিম্ন হলেও ইউনিটপ্রতি রফতানি মূল্য সর্বনিম্ন না

প্রকাশ: নভেম্বর ১৫, ২০২৩

বদরুল আলম

দেশের রফতানি খাতের প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক। এ পণ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানিকারক বাংলাদেশ। শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পান দেশের শ্রমিকরা। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ইউনিটপ্রতি রফতানি মূল্যে সর্বনিম্ন নয়। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ চিত্রই উঠে এসেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত পোশাকের রফতানি তথ্য সংকলন করে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সেই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি করা পোশাকের বর্গমিটারপ্রতি দাম কম-বেশি ওঠানামা করলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে। দেশটির আমদানিকারকদের কাছ থেকে ২০১৭ সালে প্রতি বর্গমিটার পোশাকের দাম পাওয়া যেত ২ ডলার ৭৪ সেন্ট। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ২ ডলার ৭৯ সেন্ট। ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ২ ডলার ৯০ সেন্টে। এর পরের দুই বছরে দাম কমলেও ২০২২ সালে তা ৩ ডলারের ঘরে পৌঁছে গেছে। 

সম্প্রতি পোশাক রফতানিকারক দেশগুলোয় শ্রমিকের মাসিক মজুরি কত তার একটি চিত্র দেখিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মজুরি বোর্ডের তথ্য নিয়ে করা গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, পোশাক রফতানি করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই শ্রমিককে সবচেয়ে কম মজুরি দেয়া হচ্ছে। সরকারের সর্বশেষ ঘোষিত মজুরির খসড়া সুপারিশ অনুযায়ী, পোশাক শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতকালের হিসাব অনুযায়ী ডলারপ্রতি ১১১ টাকা বিনিময় মূল্য ধরলে বর্তমানে শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১১২ ডলার ৬০ সেন্ট।অন্যদিকে খোলা বাজার বা বাণিজ্যিক ভাবে ডলারপ্রতি ১১৭ টাকা বিনিময় মূল্য ধরলে বর্তমানে শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১০৬ ডলার ৮৩ সেন্ট। ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি হয়েছে ৯৭৪ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। এ সময়ে রফতানি করা পোশাকের দাম ছিল বর্গমিটারপ্রতি ৩ ডলার ১০ সেন্ট।

বাংলাদেশের প্রতিযোগী পোশাক রফতানিকারক দেশ কম্বোডিয়ারও প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২০০ ডলার। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রফতানি করা পোশাকের অর্থমূল্য ছিল ৪৩৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার। সেখানকার আমদানিকারকদের থেকে কম্বোডিয়া রফতানি পণ্যের দাম পেয়েছে বর্গমিটারপ্রতি ৩ ডলার ২০ সেন্ট। সে হিসেবে বাংলাদেশের তুলনায় দেশটির ইউনিটপ্রতি দামে বড় ধরনের কোনো পার্থক্য না থাকলেও মজুরির ক্ষেত্রে দেখা যায় বড় তফাৎ।

রফতানির ক্ষেত্রেও ভিয়েতনামের পোশাকের ইউনিটপ্রতি দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। দেশটিতে শ্রমিকের মজুরিও অনেক বেশি। সেখানে শ্রমিকের মাসিক মজুরি ১৭০ ডলার ৩৫ সেন্ট। ২০২২ সালে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি করেছিল ১ হাজার ৮২৪ কোটি ৬৪ লাখ ২০ হাজার ডলারের। পাশাপাশি বর্গমিটারপ্রতি পোশাকের দাম পেয়েছে ৩ ডলার ৭১ সেন্ট। 

ইন্দোনেশিয়ার ইউনিটপ্রতি রফতানি মূল্যও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। একই সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। দেশটিতে নিম্নতম মাসিক মজুরি ২৪২ ডলার ৯৪ সেন্ট। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্দোনেশিয়ার রফতানীকৃত পোশাকের অর্থমূল্য ছিল ৫৬০ কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ সময়ে দেশটি বর্গমিটারপ্রতি পোশাকের দাম পেয়েছে ৪ ডলার ৫ সেন্ট।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাকের প্রতি ইউনিটের দাম কম বা বেশি হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন কাঁচামালের আমদানিনির্ভরতা, পরিবহন ও গ্যাস-বিদ্যুৎ খরচ। এগুলো ওঠানামা করলে পণ্যের দামও ওঠানামা করে। ফলে মাসিক মজুরি ও পণ্যের দামের তুলনা করে শ্রমিকের মজুরি কম বা বেশি হওয়ার ন্যায্যতা নিশ্চিত করার সুযোগ কম। তাছাড়া শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে তাদের উৎপাদনশীলতার বিষয়ও রয়েছে। সব মিলিয়ে দাম আগের তুলনায় বেশি পেয়েও শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না এমন ধারণা সঠিক নয়।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পণ্যের দাম নির্ভর করে এর কাঁচামালের দামের ওপর। যেমন ২০২২ সালে সুতার দাম ৫ ডলার পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। যে কারণে ইউনিটপ্রতি দাম বেড়ে গেছে। এ বছর সাড়ে ৩ ডলারের মধ্যে রয়েছে সুতার দাম, ফলে এ বছর পোশাকের দাম কমে যাবে। আসলে ইউনিট প্রাইস নির্ভর করে কাঁচামালের দামের ওপর। আবার আরেকটি বিষয় আছে, যেমন চীন বড় স্কেলে উৎপাদন করে, পণ্যের বৈচিত্র্যও বেশি। লো এন্ডের বহু পণ্য আছে আবার হায়ার এন্ডের পণ্যও রয়েছে। বাংলাদেশ যে ধরনের টি-শার্ট তৈরি করে, সেই টি-শার্ট চীনকে দেয়া হয় পিসপ্রতি ২ ডলার, বাংলাদেশ পায় সর্বোচ্চ ১ ডলার ৮০ সেন্ট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারচেয়েও কম। ভিয়েতনাম, ভারতকেও বেশি দেয়, আমাদের কম দেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের ধারণা বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি কম, এ কারণে দাম কম দেবে এবং আমরা কোনো না কোনোভাবে সমন্বয় করে নেব। ক্রেতাদের অন্যায্য চর্চার কারণেই শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।’ 

এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেবল মূল্যস্ফীতিকে বেশি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। উৎপাদনশীলতা ও পণ্যের দামের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচককে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসব বিষয়কে বিবেচনা ও মজুরিতে এর প্রতিফলন থাকা উচিত বলে মনে করছেন তারা। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নানা কারণে পণ্যের দাম ওঠানামা করতে পারে, সেই কারণগুলো পোশাক রফতানিকারক সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই যে দেশ কম্পিটিটিভ প্রাইস অফার করে সেই দেশের কাছে ক্রেতারা যায়। দেখা যাচ্ছে আমরা তুলনামূলক বেশি প্রাইস পাচ্ছি। এর মানে আমাদের প্রডাক্ট বাস্কেটে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, সেটার একটা সুবিধা আমরা পাচ্ছি। তবে বাড়তি দাম পাওয়া সাপেক্ষে শ্রমিকের মজুরিতে এর প্রতিফলন হওয়া উচিত। সেটা যদি চিন্তা করি তাহলে অন্যান্য দেশের ন্যূনতম মজুরি চিন্তা করলে আমাদের শ্রমিকের মজুরিতে পণ্যমূল্যের যে প্রতিফলন তা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে প্রবণতা হচ্ছে শুধু মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নেয়া হয়। কিন্তু আরো যে সূচকগুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি পণ্যের মূল্যও রয়েছে—এসব বিষয় আসলে বিবেচনায় নেয়া হয় না। আমরা মনে করি, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনা রেখে সেই ভিত্তিতে মজুরিতে এর যথাযথ প্রতিফলন থাকা উচিত।’

তবে ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, বৈশ্বিক অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি পণ্যের দাম কমেছে। বর্তমান বাস্তবতায় নতুন ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়ন কঠিন হবে। পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের অসন্তোষকে অপতৎপরতা বলে মনে করছে তারা।

বিজিএমইএর সর্বশেষ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অন্যতম প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাকের দরপতন শুরু হয়েছে, যেটা শিল্পের জন্য নতুন শঙ্কা তৈরি করছে। বিশ্ববাজার থেকে গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া পোশাকের দর ৮ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে রফতানি হওয়া পণ্যের দর কমেছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক কারণে পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বহু গুণ বেড়েছে। গত ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সময়ে গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ২৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ২১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা এসেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা যখন “‍বৈশ্বিক ও আর্থিক” এ দ্বিমুখী চাপের মধ্যে থেকেই টিকে থাকার সংগ্রাম করছি, ঠিক তখন এ শিল্পকে নিয়ে শুরু হয়েছে নানা অপতৎপরতা। বিশেষ করে আমাদের শান্ত শ্রমিক গোষ্ঠীকে উসকানি দিয়ে অশান্ত করা হচ্ছে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫