সাক্ষাৎকার

আমার শ্রেষ্ঠ কাজ কোনটি হবে তা এখনো জানি না

প্রকাশ: নভেম্বর ০৮, ২০২৩

প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট ও শিক্ষক রফিকুন নবী। তিনি রনবী নামে জনপ্রিয়। তার সৃষ্ট কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হয়েছে। পেয়েছেন একুশে পদক। চলতি মাসে তার ৮০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হবে। সে উপলক্ষে জীবনের নানা দিক ও বিবিধ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজাম আশ শামস

আঁকাআঁকির শুরুটা কীভাবে হলো?

এর তো আসলে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নেই। একেবারে ছোটবেলা থেকেই এর শুরু। সব শিল্পীর ক্ষেত্রেই এটি সত্য। কীভাবে যেন হয়ে যায় শুরুটা! পরিবার থেকেই আমি ছবি আঁকার প্রথম অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমার বাবা ছবি আঁকতেন। তাকে ছবি আঁকতে দেখেছি। ছবি আঁকার সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার এটি অন্যতম কারণ। এগুলো একেবারে ছোটবেলার কথা। আরেকটু যখন বড় হলাম, অষ্টম-নবম শ্রেণীতে পড়ি, অনুরাগ আরো গাঢ় হলো। তখন বাড়িতে অনেক পত্রিকা আসত। ব্রিটিশ আমলের কিছু পত্রিকা ছিল। ব্রিটিশ আমলের পরও কলকাতা থেকে কিছু বই-পুস্তক আসত। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতি, মাসিক মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকা আসত। সেসব পত্রিকায় বিভিন্ন শিল্পীর চিত্রকর্মের রিপ্রডাকশন ছাপা হতো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ অনেক শিল্পীর কাজের সঙ্গে তখন পরিচয় হয়। জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম মাসিক মোহাম্মদীতে পেয়েছিলাম। সেগুলো দেখে আমার ভালো লাগত। একই সঙ্গে চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের কিছু রিপ্রডাকশন আসত আমাদের দেশে। বইয়ের দোকানে সেগুলো পাওয়া যেত। বাবা সেগুলো কিনতেন। আমরা দেখতাম। এভাবেই ছবির জগতে আমার আসা। আরেকটি বিষয় বলতে চাই। তখন আমি সম্ভবত চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। বাংলা একাডেমির নাম তখন ছিল বর্ধমান হাউজ। সেখানে একটি অল পাকিস্তান ন্যাশনাল আর্ট এগজিবিশন হয়েছিল। পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পীদের চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল। বাবা আমাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রথম আমার প্রদর্শনী দেখা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে ঢাকা সরকারি আর্ট কলেজ থেকে সদ্য পাস করে বের হওয়া তরুণতম চিত্রশিল্পীদের ছবিও প্রদর্শনীটিতে ছিল। বিভিন্ন ধরনের চমৎকার সব ছবি দেখে আমি বেশ আপ্লুত হয়েছিলাম। আমিও আঁকার চেষ্টা করতাম। একটু রাফ খাতায় আঁকাআঁকি। কাগজ পেলেই আঁকতে বসে যেতাম। শিশুরা যেভাবে করে। অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সেটিই চলতে চলতে ৮০ বছর পর্যন্ত এসে পৌঁছল।

আপনার বাবা পুলিশ ছিলেন। তার বদলির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। পুরান ঢাকায়ও আপনি বেড়ে উঠেছেন। বৈচিত্র্য আপনার শিল্পীসত্তাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?

আমাদের দেশটা সুন্দর। যেদিকেই তাকাই, যেখানেই যাই, যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি, সুন্দরের সমারোহ। আমাদের দেশের ল্যান্ডস্কেপ, প্রাণিজগৎ, মানুষের জীবন সুন্দর। নদ-নদীতে ভরা। একদিকে পাহাড়, আরেকদিকে সমুদ্র। হেন কিছু নেই, যা আমাদের দেশে নেই। আমি ছোটবেলায় বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় থাকতাম। অজান্তেই আমার ভেতরে এসব নির্যাস, রস, মজা সঞ্চারিত হয়। সেসব অভিজ্ঞতা থেকেই কিন্তু আমার পরবর্তী সব নির্মাণের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। পুরান ঢাকায় তো দীর্ঘকাল ছিলাম। পড়াশোনাও সেখানেই। চতুর্থ শ্রেণী থেকে আমি পোগোজ স্কুলে পড়তাম। তখনকার ঢাকার সঙ্গে বর্তমান ঢাকার কোনো মিল নেই। পুরান ঢাকাও এখন বদলে গেছে। তাই আমি সবসময় বলি, ঢাকাকে পুরান বা নতুন না বলাই ভালো। ঢাকা ইজ ঢাকা। ঢাকায় বসবাস, লেখাপড়া, জীবনযাপন, ঢাকার মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, সব মিলিয়ে একটি অন্য রকম ব্যাপার ঘটেছিল। একদিকে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরেছি, আরেকদিকে পুরান ঢাকার শহরকেন্দ্রিক রুচি, রস, মজা। এসব অভিজ্ঞতা আমাকে তৈরি করেছে অজান্তেই। এগুলো তো ভেবেচিন্তে হয় না। সব মিলিয়েই আমার অবস্থান তৈরি হয়েছে।

আপনার বেড়ে ওঠার সময়ে ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগ্রামে উত্তাল দেশের রাজনীতি। সেগুলো আপনাকে কীভাবে আলোড়িত করেছে?

ভাষা আন্দোলনের সময় আমি তো খুব ছোট। কোথায় কী হচ্ছে বুঝতে পারতাম। আমরা তখন ঢাকার অদূরে কালীগঞ্জে থাকতাম। সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। ঢাকায় যেদিন গোলাগুলি হলো, স্কুল ছুটি দিয়ে দিল। আমাদের বলা হলো, ঢাকায় অনেক ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন। তাদের স্মরণে ছুটি। তারপর সভা হলো। আমরা সভায় অংশ নিলাম। তারপর ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথসহ বাঙালি সংস্কৃতির ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী খড়্গহস্ত হলো।৫২ থেকেই আমাদের শিল্পীরা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সে পরম্পরায় ষাটের দশকে আমরা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলাম। আমরা মিছিল সাজানোর জন্য শত শত কার্টুন, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি আঁকতাম।

নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি?

সেভাবে কোনো দল বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তবে আদর্শগতভাবে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। তখন অনেক পোস্টার এঁকেছি। এগুলো করার মাধ্যমে হাত মকশো হচ্ছে। কার্টুন আঁকছি, পোস্টার করছি, নানা দাবি নিয়ে লেখালেখি করছি, এগুলোর মাধ্যমে কিন্তু আরেক ধরনের নির্মাণ হচ্ছে আমার। এভাবেই আমাদের ওই সময়টা কেটেছে।

১৯৫৯ সালে ঢাকা সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন...

বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা শিল্পীরা সবাই আমার শিক্ষক ছিলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, শফিকুল আমিনকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তাদের সে সময়ের ছাত্র যারা, যেমন আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, কাজী আবদুল বাসেত, মোহাম্মদ কিবরিয়া, রশীদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাকসহ অনেককে পেয়েছি। একেকজনের শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটা একেক রকম ছিল। শিক্ষকদের সঙ্গে খুব কাছের সম্পর্ক ছিল। ব্যাপারে আমি খুব ভাগ্যবান। আমার রেজাল্ট ভালো ছিল। চূড়ান্ত ফল প্রকাশের তিনদিন পরই আমি আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলাম। সেই থেকে শিক্ষকতা শুরু। এখনো চলছে।

১৯৭৩ সালে আপনি স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে গ্রিসে গেলেন...

গ্রিসে হঠাৎ করেই যাওয়া। সে বছর গ্রিস সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্কলারশিপ এল। আমাদের কেউ তখন গ্রিসে যেতে চায় না। সবাই প্যারিস, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্কে যেতে চায়। সেগুলো তখন শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত জায়গা। সেখান থেকে পড়ে এলে সবাই বিখ্যাত হয়ে যায়। গ্রিসে তো কেউ কখনো যায়নি। আমিও প্রথমে গ্রিসে যেতে চায়নি। স্পেন, ইতালি হলে তাও চলে, কিন্তু গ্রিসে না। সেখানে গিয়ে কী করব! কিন্তু আমাকে জোর করে গ্রিসে পাঠানো হলো। বলা হলো, আমাদের নতুন দেশ হয়েছে। বিভিন্ন দেশ আমাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে। স্কলারশিপ দিচ্ছে। এটিকে আমাদের সম্মান জানানো উচিত। এসব শুনে আমি গ্রিসে গেলাম। ভর্তি হলাম এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্টসে। সেখানে গিয়েও দেখি আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। সরকার পতনের আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ভাংচুর হচ্ছে। আমাদের এখানে যা হতো, সেখানেও দেখছি তা- চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় তিন মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। একবার ভাবলাম, দেশে ফিরে যাই। আবার ভাবলাম, না। দাঁত কামড়ে গ্রিসে থেকে গেলাম। সেখানে আমি ছাপচিত্রে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করি। কাঠ খোদাইয়ের কাজ শিখলাম। এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্টসের ছাপচিত্র বিভাগ খুব ভালো ছিল। আমার ধারণা ছিল যে গ্রিসে সব প্রাচীন আমলের ব্যাপার। নতুন কিছু হয় না। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমার ভুল ভাঙল। আমি ভাবলাম কাঠ খোদাইয়ের কাজের সঙ্গে আমাদের শিক্ষার্থীদেরও পরিচিত করাতে হবে। এখন তো এক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ হচ্ছে। বিষয়টি দেশে আমার মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এটি নিয়ে আমি গর্বিত।

ঢাকা সরকারি আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষে থাকাকালীন আপনার একটি চিত্রকর্ম ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল...

তখন সবে ভর্তি হয়েছি। মাত্র কয়েক মাস হয়েছে। নভেম্বর বা ডিসেম্বরে ছাত্রদের বার্ষিক প্রদর্শনী হয়েছিল। তখনো আমরা কিছু শিখিইনি। বাইরে যাই। ঘরবাড়ি আঁকার চেষ্টা করি। সেগুলো ছিল পেন্সিল ওয়ার্ক। কিছু স্কেচ করেছিলাম। স্যাররা আমার তিনটি স্কেচ প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচন করেছিলেন। আহামরি কিছু নয়। আমার দুটি স্কেচ বিক্রি হয়েছিল। একটি কিনেছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। আরেকটি কে কিনেছিল আমার মনে নেই। প্রতিটি ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তখন আমাদের সিনিয়র শিক্ষার্থীদের ছবি ২৫০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হতো। আমাদের কাছে তখন তা আকাশচুম্বী। আমাদের জন্য ১৫ টাকাই অনেক। দুটি ছবি বিক্রি করে ৩০ টাকা পেলাম। বন্ধুরা সব ধরল। সে টাকায় তাদের খাওয়াতে হবে।

ছবিগুলোর বিষয় কী ছিল?

এমনি ঘরবাড়ি। একটি সম্ভবত কুঁড়েঘর। আরেকটি বোধ হয় কাঠের সাঁকো। দয়াগঞ্জের কাঠের সাঁকো দেখে এঁকেছিলাম। তখন যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, দয়াগঞ্জ ছিল গ্রাম। সেখানে ছবি আঁকতে চলে যেতাম। যা- হোক, ছবি বিক্রি হওয়ায় বেশ উদ্দীপনা পেলাম।

সেটিই কি ছবি বিক্রি থেকে আপনার প্রথম উপার্জন?

না। তখন আমি মাত্র আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছি। তিন-চারদিন হবে। আমার পাড়ার উর্দুভাষী এক যুবক টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পড়ত। সেখানে তাদের ছবি আঁকার একটি কোর্স ছিল। তার নাম আমার মনে নেই। একদিন সে আমাকে একটি সিংহ এঁকে দিতে বলল। আমি সিংহ জীবনে দেখিইনি। কীভাবে আঁকব! সেও নাছোড়বান্দা। টারজানের সিনেমায় সিংহ দেখেছিলাম। সেটি একটু মনে আছে। আর ছবিতে দেখেছি। কিন্তু তাতে আঁকাটা কেমন হবে, ব্যাপারে সন্দিহান ছিলাম। তারপর বইপত্র ঘেঁটে একটি রাজবাড়ির ছবি বের করলাম। রাজবাড়ির প্রবেশদ্বারে দুদিকে দুটি সিংহের ভাস্কর্য। সেটিই আঁকার চেষ্টা করলাম। ছোট একটি ছবি। তিন-চারদিন পর সে যুবক এল। ছবি দেখে মহাখুশি হলো। বেশ প্রশংসা করল। তারপর সে পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে আমার হাতে দিল। আমি জানতে চাইলাম, কী ব্যাপার। বলল, তুমি যে ছবিটা আঁকলে। আমি তো বেশি কিছু দিতে পারব না। এটুকু রাখো। সেটিই আমার প্রথম উপার্জন। ১০ টাকা। তারপর হলো ১৫ টাকা। ঘটনাটি ভাবলে এখনো বেশ ভালো লাগে।

আর্ট কলেজে পড়ার সময় থেকেই তো পত্রিকায় কাজ শুরু করলেন...

তখন আমি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তখন পূর্বদেশ, অবজারভার চিত্রালীতে শিল্পী কালাম মাহমুদ ছিলেন। আমি তখন ছোটদের বইয়ে কিছু ইলাস্ট্রেশন করতাম। প্রায় বিনা পয়সায় করার মতো। তখন কালাম মাহমুদের মাধ্যমে বোধহয় কবি আবদুল গনি হাজারী আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আমাকে পত্রিকায় কাজ করতে বললেন। প্রথমে পার্ট টাইম। মাসিক ২৫০ টাকা বেতন নির্ধারিত হলো। তারপর পাস করে বের হওয়ার পর ওয়েজ বোর্ডে নেবে। এটি ১৯৬৩ সালের দিকের ঘটনা। পাস করে শিক্ষক হওয়ার পর পত্রিকার চাকরি ছাড়তে হলো।

পত্রিকায় আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

পত্রিকায় চাকরি করার সময় বড় বড় সাহিত্যিক কবির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রশীদ হায়দার, ফজল শাহাবুদ্দীন, এটিএম আব্দুল হাই, ফতেহ লোহানীসহ অনেকেই ছিলেন। তাদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা হতো। সময়টা বেশ মজার ছিল।

তাদের মাধ্যমেই কি লেখার অনুপ্রেরণা পেলেন?

বলা যায়। তাদের লেখাগুলোয় ইলাস্ট্রেশন করতাম। ছোটবেলা থেকেই শিশুতোষ বই পড়তাম। কলকাতা থেকে বিভিন্ন পূজা সংখ্যা আসত। সেগুলো পড়তাম। স্কুলে, পাড়ায় দেয়াল পত্রিকায় লিখতাম। রাশিয়ার স্পুৎনিক যখন প্রথম মহাশূন্যে গেল, সেটির ওপর একটি লেখা লিখেছিলাম। সেটি ইত্তেফাকে বক্স করে ছাপানো হয়েছিল। খুবই আনন্দের ব্যাপার ছিল। মূলত শিশুদের জন্যই লিখেছি। বড়দের জন্যও উপন্যাস লিখেছি। লেখালেখি আমার অবসরের কাজ। ভালো লাগা থেকেই লিখি। সাহিত্যিক বা কবি হওয়ার জন্য নয়।

সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?

শাহাদাত চৌধুরী আমার ছেলেবেলার বন্ধু। পরে তিনি বিচিত্রার সম্পাদক হলেন। তার অনুরোধে আমি বিচিত্রায় কার্টুন আঁকা শুরু করলাম। তখন টোকাইয়ের জন্ম হলো। অনেক চিন্তা করে টোকাই নামটি আবিষ্কার করলাম। তারপর তো টোকাই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেল। টোকাই শব্দটি অভিধানে স্থান পেল। বাইরের এনসাইক্লোপিডিয়ায়ও টোকাই জায়গা করে নিল।

বাংলাদেশে চিত্রশিল্পের বাজার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন...

আগে বিদেশীরা আমাদের শিল্পীদের কিছু ল্যান্ডস্কেপ কিনত। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের মূল চিত্রকর্মগুলো তেমন বিক্রি হতো না। তারা বিক্রিও করতে চাইতেন না। দামও এত কম ছিল যে বিক্রি হওয়া না হওয়া একই ব্যাপার ছিল। চিত্রকর্মের মধ্যে জলরঙ বেশি বিক্রি হতো। তবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদের চিত্রকর্ম বেশ ভালো দামেই বিক্রি হতো। আমার মনে আছে, ১৯৬৫ সালে এক প্রদর্শনীতে জয়নুল আবেদিনের জলরঙে আঁকা ছোট একটি চিত্রকর্ম ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এটি তখন আমাদের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন ছিল। বিদেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের তো বাজার বলতে কিছু নেই। এমনকি ভারতেও কিন্তু শিল্পীরা ছবি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। আমাদের এখানে কিন্তু তা হয়নি। যদি কেউ খুব বিখ্যাত হয়ে যায়, তখন তার কিছু চিত্রকর্ম বিক্রি হয়। তবে একটি ভালো লক্ষণ হলো এখন বিদেশী নয়, দেশের মানুষই ছবি কেনে। এটি আনন্দের বিষয়।

আপনার চিত্রকর্ম সর্বোচ্চ কত দামে বিক্রি হয়েছে?

তা মনে নেই। তবে আহামরি কিছু নয়। আমি বলে না, আমাদের দেশের কোনো শিল্পীর পক্ষেই কেবল চিত্রকর্ম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্পজগৎ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন...

একটি অসাধারণ সময় অতিবাহিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগ। সারা বিশ্বকে আমরা চট করে দেখে ফেলছি। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম সে সুফল ভোগ করছে। সব মিলিয়ে তাদের মেধা আরো ক্ষুরধার হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম অনেক ভালো কাজ করছে। আমি খুবই আনন্দিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।

জীবনের ৮০তম বসন্তে এসে কি মনে হয়, যা আঁকতে চেয়েছিলেন তা এখনো আঁকা হয়নি?

অবশ্যই। সব শিল্পীরই অতৃপ্তিটা থেকে যায়। প্রতিটি ছবি আঁকার সময় মনে হয়, এটিই বোধহয় আমার শ্রেষ্ঠ কাজ হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। অতৃপ্তি নিয়েই শিল্পীদের বিদায় নিতে হয়। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতো শিল্পীরাও অতৃপ্তি নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন। পাবলো পিকাসো মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, যা করতে চেয়েছিলাম, হলো না। পারলামই না। জয়নুল আবেদিন মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন যে অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল। হলো না। আমারও সে অতৃপ্তি আছে। আমার শ্রেষ্ঠ কাজ কোনটি হবে তা এখনো জানি না। হয়তো কোনোদিন হতে পারে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫