নির্জনবাসের প্রিজমে বিভাজিত সময়

প্রকাশ: অক্টোবর ২৫, ২০২৩

ওয়াহিদ সুজন

কোয়ারেন্টিন। ৪০ দিন। ভেনেশিয়ান ভাষায় দুই শব্দের মানে একই। ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে ইতিহাসে কুখ্যাত প্লেগের সময় যাত্রী ও জাহাজকর্মীদের তীরে নামার আগে স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহার হতো। ৪০ দিনের আরো অনেক দ্যোতনা আছে। যেমন নবী মুসা (আ.) তার সম্প্রদায় থেকে একা তুর পাহাড়ে ৪০ দিন সময় কাটান। আল্লাহর কাছে নিয়ে আসেন নির্দেশনা। যেখানে আছে ভবিষ্যতের দিশা। অর্থ দিলেন অতীতকেও। এর বাইরে কোয়ারেন্টিন যে এজমালি অর্থ নিয়ে আসে, তা হলো নিজের জীবনযাপনকে পরিচিত বৃত্ত থেকে গুটিয়ে এনে নির্জনবাস বা বাড়াবাড়িভাবে রোমান্টিসাইজ করলে অজ্ঞাতবাস।

হাল আমলে ‘কোয়ারেন্টিন’ শুধু ৪০ দিনে সীমাবদ্ধ নয়, যা করোনাকালে দেখেছি। এ বিচ্ছিন্নতার কারণে মানুষ কে কী অর্জন করে তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। দৃষ্টিভঙ্গি, অনুসন্ধানের ভঙ্গি, আর্থিক সংগতি, বয়স বা পেশাগত তৎপরতার ওপর।

মাহবুবুর রহমানের প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘কোয়ারেন্টিন’ অনেক স্মৃতি-শ্রুতি জাগিয়ে দিলেও তাকে নামকরণের প্রেরণা জুগিয়েছে আইরিশ নারীবাদী কবি ইভান বোল্যান্ডের লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘কোয়ারেন্টিন’। যার পরিপ্রেক্ষিত ছিল উনিশ শতকের মধ্যভাগের পটেটো ফেমিন বা আইরিশ ফেমিন।

মাহবুবুর রহমান বলছেন, ‘কোয়ারেন্টিন এক অর্থে সময়ের প্রতিচ্ছবি’। এর সঙ্গে আমরা নিজেদের ভাগাভাগি করে নিতে পারি। শৈল্পিক সূক্ষ্ম অনুভূতিকে হবু দর্শকের সামনে হাজিরে যে আইডিয়া ও মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেছেন তা সামগ্রিক আয়োজনের দিক থেকে অভিনব হলেও দর্শকের হৃদয়ের কাছাকাছি যেতে সময় নেয় না। বিস্ময়সমেত। বরং টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষের ইতিহাস পড়ে ফেলা যায়। যেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো মাধ্যম ব্যবহার না করে নানাভাবে তৎপর শিল্পী, যা একই সঙ্গে শিল্পের স্বাধীনতা ও দায়কে একীভূত করে।

প্রদর্শনীর শুরুতেই সিরিজ ফটো এচিং ‘ম্যাডোনা’। মানুষের নাজুকতা, অসহায়ত্ব, ভালোবাসা ও অতিমানবিক অবয়বে ম্যাডোনা এবং দৈব শিশুর গল্প বারবার উঠে এসেছে ধর্ম-মিথ, চিত্রকলা ও সমূহ পরিসরে। ধর্মীয় খোলস ভেঙে হয়ে উঠেছে চিরকালীন গল্প। মাহবুবুর রহমানের ‘ম্যাডোনা’ করোনার নির্জনবাসের সময়কালে মানুষ ও প্রাণীর যে যূথবদ্ধতা তা তুলে ধরে। এবং শিল্পীর একদম ব্যক্তিক অনুভূতির ভেতর দিয়ে। এক্ষেত্রে মাহবুবুর ও তার পরিবারের অন্যা সদস্যরা ফটো এচিংয়ে হাজির হন। যেখানে দৃশ্য ও দৃশ্যের বাইরের রক্ত-মাংসের মানুষের একাত্ম হওয়ার মাঝে আলাদা কোনো অর্থ-অনর্থ নেই। বরং মানুষের চিরায়ত যূথতা বিশেষ থেকে সার্বিকে পরিণত হয়। সে বিশেষকে ধারণ সহজসাধ্য নয়, চর্চারও বিষয়। মাহবুবুর রহমান এখানে জীবন-মৃত্যু, আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। বলছেন, ‘‌... এই চলে যাওয়া, নতুনের আগমন, আর হারানো-প্রাপ্তির মিশ্র অনুভূতিকে ঘিরে তৈরি হয় আমার “‍ম্যাডোনা’’ সিরিজের ছাপাই চিত্র।’

‘কোয়ারেন্টিন’ ইতিহাসের নানা বাঁক, পরম্পরা নিয়ে কথা বলেছে। মানুষের সংগ্রামের গল্পগুলো নাড়া দিয়েছে শিল্পীকে। টিকে থাকার লড়াই, অধিকারের লড়াই শেষ পর্যন্ত বিশেষ ভাষা বা জনগোষ্ঠীর একান্ত হয়ে থাকে না আর। এ প্রদর্শনী সাক্ষ্য দিচ্ছে, চিন্তাকে আরো পরিসর ও বিস্তৃতি দিতে সম্ভবত সদা ব্যস্ত জীবন থেকে বিরতি নিতে হয়। যেমন দর্শনের সঙ্গে অবসরের সম্পর্ক দেখেছিলেন অ্যারিস্টটল। ‘কোয়ারেন্টিন’ ও সাময়িক দুনিয়ার নিদারুণ বাস্তবতার বাইরেও শিল্পীকে যেতে হয়েছে। অথবা কোয়ারেন্টিনকে আরো বিস্তৃত অর্থ দিয়েছেন।

ম্যাডোনা যেমন নাজুক মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন দেখায়, অন্য গল্পগুলোও ইতিহাসের স্থান করে নেয়া কিছু গল্প নিয়ে আসে সামনে। শিল্পী বলছেন, ‘‌লকডাউনের সময় বেড়ে গিয়েছিল আমাদের মিডিয়া নির্ভরতা। তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভর করে বন্দি মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে, খবরাখবর নেয়। ঘরে বসেই যেন বিশ্বভ্রমণ! মানুষের সব মনোযোগ তখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কোথায় কী ঘটছে, বিশেষ করে কভিড-১৯-সংক্রান্ত খবরাখবরের প্রতি। স্থবির সময়ে অস্থির তখন টেলিভিশনের পর্দা। একটা ঘটনা শেষ না হতেই অন্য কোনো ঘটনার খবর হেডলাইন আকারে ভেসে উঠত টিভি স্ক্রিনে। একের পর এক ঘটনা, যেমন “‍ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’’, “‍ফার্মারস মুভমেন্ট’’-সহ দুর্ভিক্ষ, খাদ্য রাজনীতি, স্বাধীনতাকামী মানুষের জয়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষ, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, কভিড-১৯ টিকাকে কেন্দ্র করে নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব এসবই তখন শিল্পসৃষ্টির অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।’

আগ্রহ ও হাতে অফুরান সময় থাকায় নানা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে গবেষণা ও ভাবনা শুরু করেন মাহবুবুর রহমান। কাজের পরিধি দাঁড়ায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরের ঘটনা পরম্পরা। প্রদর্শনীতে এসেছে মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজয়, কোহিনুরের হাতবদল, তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে দিলীপ সিংয়ের রাজ্য পরিচালনা, তাকে জোর করে ধর্মান্তর করিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া। সেখানে আছে আরেক ইতিহাস। পরবর্তীকালে দিলীপ সিংয়ের মেয়ে সোফিয়া আলেক্সান্দ্রোভনা লন্ডনে জড়িয়ে পড়েন নারীর ভোটাধিকার বা সাফ্রেজ আন্দোলনে।

এসব ঘটনার ব্যাপ্তি ও জটিলতাকে সহজবোধ্য করার পথে হাঁটেননি মাহবুবুর রহমান। বরং এসব ভাবনাকে শিল্পরূপ দিতে গিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যবহার করেছেন। একীভূত করেছেন। ধাতব ভাস্কর্য, সূচিকর্ম, ছাপচিত্র, শিল্পীর তৈরি বই থেকে অঙ্কনচিত্র কী নেই। রঙ-তুলি-ক্যানভাস নির্ভর জগতের বাইরে গিয়ে নানা পেশার মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। যাকে বলছেন ‘কমিউনিটি নির্ভর প্রকল্প’। এ ডাইমেনশনগুলো দিয়েছে নতুন অভিজ্ঞতা।

শুরুতে ‘কোয়ারেন্টিন’ প্রসঙ্গে ধর্মকে টেনে এনেছিলাম। বলছিলাম ভবিষ্যৎ ও অতীতের অর্থ নির্মাণ নিয়ে। হয়তো ‘কোয়ারেন্টিন’ সৃজনশীল মানুষের কাছে কখনো সাদামাটা অর্থে থাকে না। মাহবুবুর রহমানের প্রদর্শনী তো তার নির্জলা উদাহরণ। গত এক-দেড় বছরে ঢাকায় অনেক দৃশ্য শিল্পের প্রদর্শনীর বিষয় ছিল করোনা ও কোয়ারেন্টিন। হলফ করে বলা না গেলেও মাহবুবুর রহমানের ‘কোয়ারেন্টিন’ প্রদর্শনীর আইডিয়া ও তার রূপায়ণের দিক থেকে স্থানিক যেকোনো গল্পকে ছাপিয়ে গেছে। আর ‘সময়ের প্রতিচ্ছবি’ হয়ে উঠেছে সেই প্রিজম, যার ভেতর দিয়ে সময়ের নানা মাত্রা একই গ্যালারিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যার মূল কথা মহাকালে মানুষের সংগ্রাম ও তার জিতে যাওয়া। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫