ঢাকার চার এলাকায় অর্ধশতাধিক নার্সিং কলেজ

হাসপাতাল নেই সিংহভাগের প্রশ্নবিদ্ধ মূল্যায়ন পদ্ধতি

প্রকাশ: অক্টোবর ১৮, ২০২৩

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি ক্লিনিকগুলোয় নার্স হিসেবে কাজের সুযোগ বাড়ছে। দেশের বাইরেও নার্সিং পেশায় যুক্ত হচ্ছেন অনেকে। এর সুযোগ নিয়ে গড়ে উঠেছে একের পর এক মানহীন নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে সিংহভাগেরই নেই একাডেমিক ভবন, হোস্টেলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষক, দক্ষ জনবল কিংবা শিক্ষা উপকরণ। এমনকি ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের জন্য নিজস্ব হাসপাতালসহ নার্সিং শিক্ষার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেই। ভবন বা ফ্লোর ভাড়া নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও রয়েছে গলদের অভিযোগ।

সরজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বরের একটি ভবন ভাড়া নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেসরকারি সাইক নার্সিং কলেজ। তার পাশের ভবনেই হামিদা নার্সিং ইনস্টিটিউট নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। ওই এলাকার সাড়ে তিন কিলোমিটার ঘুরে চোখে পড়ে আরো পাঁচ নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সাইক থেকে আল-হেলাল নার্সিং ইনস্টিটিউটের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার, মিরপুর নার্সিং ইনস্টিটিউটের দূরত্ব ২ দশমিক ৩, ট্রমা নার্সিং ইনস্টিটিউটের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ইনস্টিটিউটের দূরত্ব ৩ দশমিক ২ ও নর্থওয়েস্টার্ন নার্সিং কলেজের দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার।

শুধু মিরপুরেই নয়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি ও মগবাজার—এ চার এলাকায়ই রয়েছে অর্ধশতাধিক নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ধানমন্ডি এলাকায় স্কয়ার কলেজ অব নার্সিং ও নর্দার্ন ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৩০০ মিটার। আর সাড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে আরো সাত নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কয়ার থেকে যমুনা ফাউন্ডেশন অব নার্সিংয়ের দূরত্ব এক কিলোমিটার, স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্সেসের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার, ডিসিএমটি নার্সিং ইনস্টিটিউটের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার, সেন্ট্রাল হসপিটাল নার্সিং ইনস্টিটিউটের দূরত্ব তিন কিলোমিটারের কিছু কম, ইউনিহেলথ নার্সিং কলেজের দূরত্ব সোয়া তিন কিলোমিটার ও গুলশানারা নার্সিং কলেজের দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটারের কিছু বেশি। 

মোহাম্মদপুরে বুফাইদা কলেজ অব নার্সিং ও নাইটিংগেল নার্সিং কলেজের দূরত্ব মাত্র ২০০ মিটার। ওই এলাকায় চার কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে আরো সাতটি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মগবাজার ও শাহবাগ এলাকায়ও প্রায় একই অবস্থা। কোনো কোনো এলাকায় আবার একই ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রের চাহিদার কথা বিবেচনা করে বিগত কয়েক বছরে দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নার্সিং ডিগ্রি। এ কারণেই বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউট বেড়েছে। তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় অংশই আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নার্সিং শিক্ষার মান নিশ্চিতে সরকার ২০১৫ সালে ‘বেসরকারি পর্যায়ে নার্সিং কলেজ বা নার্সিং প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও নার্সিং কোর্স চালুকরণসংক্রান্ত নীতিমালা’ নামে একটি বিধি পাস করে। নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিষয়ে নীতিমালায় বেশকিছু শর্ত রয়েছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে ৫০ ছাত্রীর জন্য প্রতিষ্ঠানটির কমপক্ষে ৩০ হাজার বর্গফুটের একাডেমিক ভবন থাকতে হবে। শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সঙ্গে ভবনের পরিধি বাড়বে আনুপাতিক হারে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রয়োজনীয় আসবাবসহ পৃথক আবাসন সুবিধা নিশ্চিত 

করার কথাও বলা হয় নীতিমালায়। একাডেমিক মান নিশ্চিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ল্যাব কোর্সে আট শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক থাকবেন একজন, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও ল্যাব সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্র্যাকটিসের জন্য ন্যূনতম ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নিজস্ব হাসপাতাল থাকতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে নিজস্ব হাসপাতাল না থাকলে ন্যূনতম ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি থাকতে হবে। 

সরজমিনে ঢাকার নার্সিং কলেজগুলো পরিদর্শন করে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি বেসরকারি নার্সিং প্রতিষ্ঠানেই মানা হয়নি এসব শর্ত। মিরপুর এলাকার ১০টি নার্সিং ইনস্টিটিউটের মধ্যে কেবল দুটি নার্সিং কলেজের নিজস্ব হাসপাতাল ও একাধিক ভবন রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি নার্সিং কলেজই একটিমাত্র ভবনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে শিক্ষক সংকট। একই অবস্থা মোহাম্মদপুরের নার্সিং কলেজগুলোরও। 

মিরপুরের দুটো নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হামিদা নার্সিং ইনস্টিটিউট ও সাইক নার্সিং ইনস্টিটিউট সাইক গ্রুপের মালিকানাধীন। গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা জেলায় মোট পাঁচটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এ গ্রুপের মালিকানাধীন। সাইক গ্রুপের মালিকানাধীন অন্য তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মাদার কেয়ার নার্সিং ইনস্টিটিউট, অ্যাডভান্সড নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মাদার কেয়ার মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউট। তবে ওয়েবসাইটে শিক্ষকদের বিষয়ে দেয়া তথ্য বলছে, তাদের পাঁচ নার্সিং ইনস্টিটিউটের জন্য শিক্ষক সংখ্যা কেবল ১২। যদিও সাইক নার্সিং কলেজ ও হামিদা নার্সিং ইনস্টিটিউটেই শিক্ষার্থী রয়েছেন সহস্রাধিক।

মিরপুরের আরেক প্রতিষ্ঠান মিরপুর ইনস্টিটিউট অব নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারিতে গিয়ে দেখা গেছে, ছয়তলা ভবনের নিচতলায় ইসলামী ব্যাংকের বুথ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার, দ্বিতীয় তলায় স্পার্ক ডেন্টাল কেয়ারের অফিস ও তৃতীয় তলায় নার্সিং ইনস্টিটিউট। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ইনস্টিটিউটটিতে পর্যাপ্ত শিক্ষক, শ্রেণীকক্ষ ও আবাসন সুবিধা নেই। আছে ল্যাব সংকট। 

বেসরকারি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পর্যাপ্ত মান নিশ্চিত না হওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি নার্সিং লাইসেন্সিং পরীক্ষায় ফুটে উঠেছে। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি এবং সমমানের ডিগ্রি সম্পন্নকারীদের পেশাগত জীবনে প্রবেশের জন্য নিবন্ধন নেয়া বাধ্যতামূলক। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের অধীনে এ নিবন্ধন নিতে উত্তীর্ণ হতে হয় কম্প্রিহেনসিভ (লাইসেন্সিং) পরীক্ষায়। যদিও গত ২৯ সেপ্টেম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৮০ শতাংশই অকৃতকার্য হয়েছেন। মোট ৩ হাজার ২৫৬ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন কেবল ৬৭৪ জন। 

বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রশিদুল মান্নাফ কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নার্সিং কলেজগুলোর অধিকাংশই ২০২১-এর আগে অনুমোদন পেয়েছে। গত দুই বছরে নতুন মাত্র তিন-চারটি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। নার্সিং কলেজগুলোর বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমরাও বিভিন্ন অভিযোগ শুনছি। এ কারণে শিক্ষার মান নিশ্চিত না হয়ে এখন আর কোনো কলেজের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। আগে অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও যাতে প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় কঠোর হচ্ছে। সেই সঙ্গে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে নতুন বিধিমালা তৈরি হচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যেই তা পাস হবে। আগের তুলনায় এ বিধিমালা কঠোর হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো আইন লঙ্ঘন করে বা আইনে উল্লেখিত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে পরিচালনা করতে পারবে না।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে দক্ষ নার্সের বিকল্প নেই। কিন্তু দেশে বেসরকারি নার্সিং প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষত গত কয়েক বছরে নতুন যে নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলো নিবন্ধন পেয়েছে তার বেশির ভাগই দু-তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের কিছু কর্মকর্তা সিন্ডিকেট করে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তির নামে বেসরকারি নার্সিং কলেজের অনুমোদন দিয়ে আসছেন। এমনকি টাকার বিনিময়ে ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানকেও নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের বেসরকারি নার্সিং কলেজগুলো সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। এর অধিকাংশকে নিয়ে অভিযোগ থাকলেও অধিদপ্তরের কিছু করার সুযোগ নেই। আমরা সাধারণত সরকারি কলেজগুলো পরিদর্শন করে থাকি। জানামতে দেশের বেসরকারি নার্সিং কলেজগুলো মূলত কয়েকটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে সাইক নার্সিং কলেজের চেয়ারম্যান আবু হাসনাতের প্রায় ৪৪টি নার্সিং কলেজ রয়েছে। ডিডব্লিউএফ নার্সিং কলেজের চেয়ারম্যান মো. জহিরুল ইসলামের নামে নিবন্ধন রয়েছে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটিও হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’

নার্সিং শিক্ষার প্রসারে কয়েক মিটার পরপর নার্সিং কলেজ প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন স্বাস্থ্য শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। দেশে মূলত প্রয়োজন ভালো সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন কলেজ। সেই সঙ্গে এভাবে প্রতিষ্ঠান খোলা বন্ধ করতে হবে। তাদেরই কেবল অনুমোদন দিতে হবে যারা প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি নিয়মিত কঠোর মনিটরিং জরুরি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে বর্তমানে নার্সিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়লেও অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে না। ফলে কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের যা যা শেখার কথা তারা তা শিখছে না। এ কারণে একটি ইনস্টিটিউটকে তখনই ভর্তির অনুমতি দেয়া উচিত যখন সে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষার্থীসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে। সেই সঙ্গে নীতিমালা মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা কঠোর মনিটরিং করতে হবে। যেসব ইনস্টিটিউটে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, সুযোগ-সুবিধা নেই, প্রয়োজনে তাদের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।’ 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫