উদগ্র বাসনা ও প্রশ্নবিদ্ধ প্রগতি

প্রকাশ: অক্টোবর ১৮, ২০২৩

মো. বজলুর রশিদ শাওন

পদার্থবিজ্ঞানে গতি হলো এমন ঘটনা যেখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন হয়। তো অমৃতস্য পুত্র কিংবা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে দাবি করা মানুষ তো নিশ্চয়ই নিজের অবস্থানের পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধনকে শুধু গতি বলেই থেমে থাকবে না। তাই তাকে ‘প্র’ নামক একটা উপসর্গ যোগ করে ‘প্রগতি’র কথা বলতে হয়। বস্তুগত উন্নয়নের এই যে প্রগতি, তা অসংখ্য রঙে রাঙানো। একটা রঙ ফিকে হয়ে যাওয়ার আগেই আরেকটা রঙে নিজেকে মুড়িয়ে ফেলার যে উদগ্র বাসনা, তারই ফলাফল আজকের এ বিশাল গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো, পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আর সামষ্টিক ফলাফল হিসেবে আমাদের এ সমাজ সভ্যতা। প্রশ্ন হচ্ছে গন্তব্য কোথায়? উত্তর জানা নেই। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়াটাও মুশকিল সম্ভবত। তবে মানবিক বৈশিষ্ট্যের ছাতার নিচে এমন কতগুলো প্রবৃত্তি স্থান পেয়েছে, যা অনেকটাই আয়নার মতো। ছুটে চলার মাঝে কর্তা সত্তাকে কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে প্রশ্ন করতে শেখায়। শিল্পী তানভীর পারভেজ তার ‘গতি ও অগতির বচন’ নামক প্রদর্শনীতে এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছেন রাজধানীর কলাকেন্দ্র গ্যালারিতে।

ব্যক্তি শিল্পী যে বাস্তবতাকে তুলে ধরতে চান দর্শকও কি সেভাবেই উপলব্ধি করে? নাকি তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধি করে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দর্শক তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই উপলব্ধি করে। যেটা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় ভাষাতত্ত্বের কনোটেশন ও ডিনোটেশন দিয়ে। তাই শিল্পকর্ম দর্শকের সামনে হাজির হওয়ার পর শিল্পীর বক্তব্য গৌণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা হাজির হয় বহুলাংশে। সাধারণত শিল্পবস্তুর অর্থ বুঝতে বা শিল্পীর বক্তব্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে শিল্পবস্তুর শিরোনামকে সূত্র হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন একজন দর্শক। কিন্তু একই শব্দের দ্যোতনা ব্যক্তিভেদে যেমন ভিন্নতর হয়, তেমনি শিরোনামের বিপরীতে একজন শিল্পী তার শিল্পকর্মে স্থির কিংবা চলমান যতগুলো দৃশ্যরূপ হাজির করেন, তা অবধারিতভাবেই আরো অসংখ্য চিন্তার খোরাক তৈরি করে। এ প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে তা আরো বেশি, কেননা শিল্পী তার কোনো শিল্পকর্মের নামকরণ করেননি। ফলে দর্শক হিসেবে আমাদের কাছে সূত্র বলতে প্রদর্শনীর শিরোনাম। ফলে স্বাধীন দর্শক হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতার ছাপ হিসেবেই আমাদের উপলব্ধি তৈরি হচ্ছে শিল্পকর্মের সামনে গেলে। শিল্পী নিজেও সেটাই বিশ্বাস করেন। তাই তিনি ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘শিল্পকর্মের কোনো পূর্ণাঙ্গ অর্থ নেই। উপস্থাপনের অভিনবত্বের ভেতর দিয়ে দর্শক এর অর্থকে সম্পূর্ণতা প্রদান করে। অর্থাৎ শিল্পকর্মের ভাষা বা অর্থ তৈরি হয় দর্শক ও শিল্পকর্মের আলাপচারিতার মাধ্যমে।’

মূলত সমাজ বাস্তবতার কতগুলো ভয়াবহ উপসর্গ হাজির হয়েছে এ প্রদর্শনীতে। ধূসর কালো এক পরিবেশ তৈরি করেছেন শিল্পী। যেখানে স্থির চিত্রগুলোয় ধূসর ঘাসের ওপর দর্শকের দিকে অস্ত্র তাক করে থাকা ক্ষমতাবান এক সেনার ছায়া, বিশালদেহী হাতি আর ক্ষুদ্র ইঁদুরের লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য, কলসি কাঁখে গ্রামীণ নারীর ছায়া, সাইকেল চালানো মানুষের ছায়া, যেখানে মানুষের চেয়ে সাইকেলটাই মুখ্য (যেন মানুষের নিয়ন্ত্রক সাইকেল) ইত্যাদি। সভ্যতা নামক মুখোশের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের তৈরি প্রথার প্রতিরূপগুলো জীবন্ত এখানে। ক্ষমতা ভাগাভাগির ফসল হিসেবে যাদের স্বতঃস্ফূর্ততা বিপন্ন হয়েছিল, এ যেন তাদের চিহ্ন।

ঘূর্ণায়মান তিনটি অবজেক্টে আরো ভয়াবহতা লক্ষণীয়। নিচ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ যদি হয় সভ্যতা নামক আলো, তবে তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ছায়াময় দৃশ্য, যা অসভ্যতার শামিল। প্রথমটির (বা দিক থেকে) ওপরে তিনটি ধূসর পুতুলের (শিশু) মুখ, ওষুধ বেয়ে পড়া মাতৃস্তনের দিকে তাকিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরছে। যেন সভ্যতার চরম অসভ্য চেহারা প্রকটিত হচ্ছে বারংবার। শিশুর জন্য অনিরাপদ এক সময়। দ্বিতীয়টির ওপরে সুফি দরবেশের মতো এক কাঁধ উঁচু, আরেক কাঁধ নিচু করে একদিকে সজোরে ঘুরছে একটি উড়োজাহাজ, অন্যদিকে একটি কলম। এ যেন ভীষণ গতিময় সমাজ-রাষ্ট্র, জ্ঞান যেখানে ছুটতেই শেখায় ফানা হওয়ার নেশায় ঘুরতে থাকা দরবেশের মতো। তৃতীয়টিতে সমসাময়িক পণ্যাসক্তির অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশ্ববিখ্যাত অ্যাপল ব্র্যান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকা ক্ষুদ্রকায় রোবোটিক মানুষ। 

তার স্থাপনাধর্মী ও দ্বিমাত্রিক চিত্রের একটা বড় অংশেই মূলত মানব অবয়বের বন্দিত্ব দেখা যায়। স্বচ্ছ রেজিনের ঘনকে আবদ্ধ মানুষের অবয়ব, দোদুল্যমান সবুজ ঘাসের ওপর মানব অবয়বের ছায়া কিংবা কাচের ঘরে পরাবাস্তবতার মহাসড়কে হ্যালোজেন লাইটের নিচে একা মানুষের গল্প। ছোট ছোট পেইন্টিংয়ের সামনে গ্লাসের স্তরে মানুষের অভিব্যক্তিগুলোর ইল্যুশন তৈরি করেছেন, যেন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমাদেরই প্রশ্ন করে সত্তার স্বরূপ নিয়ে। বড় দুটো পেইন্টিংয়ে মানুষের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ও সমাজ ভাঙনের গল্প খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

পুঁজির শাসনের অধীনে মানুষের বন্দিদশার গল্প এ প্রদর্শনী। যেখানে হাড্ডিসার কঙ্কালের ওপরেও জোরপূর্বক মাংসপেশি চাপিয়ে দিয়ে দেখানো হয় উন্নয়নের ফিরিস্তি। শুধু বিশ্ব ব্যবস্থা নয়, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার প্রতিফলনও মিলবে এ প্রদর্শনীতে। বারবার প্রশ্ন উঠবে এ প্রগতির গতিমুখ কোনদিকে? যে প্রগতি সমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে সে প্রগতির অর্থ কী?


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫