কিডনির যত্ন

যথাযথ নিয়ম মানলে অনেকেরই কিডনি বিকলতা রোধ করা সম্ভব

প্রকাশ: অক্টোবর ০২, ২০২৩

ডা. শেখ মইনুল খোকন

পৃথিবীতে ৮৫  কোটি মানুষের কোনো না কোনো কিডনি জটিলতা আছে। আর এর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি সমস্যায় ভুগছে পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে ২ কোটি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে। আর ২০১৯-২০ সালের সমীক্ষা অনুসারে কিডনি রোগে মৃত্যুর হার বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা গ্রহণের হার ১০-১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১৫-২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে কিডনি বিকল রোগীদের প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ ডায়ালাইসিস শুরু করে এক-দেড় বছর পর আর চিকিৎসা চালাতে পারে না। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এ হার কিছুটা কমছে। এই যে বিশালসংখ্যক মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা যথাযথ নিয়ম মেনে চললে একটি সন্তোষজনক সংখ্যক মানুষের কিডনি বিকলতা রোধ করা যায়। 

পরিমিত পানি পান: একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দুই-তিন লিটার পানি পান করা উচিত। তবে গর্ভবতী মায়েদের অতিরিক্ত ৫০০ মিলিলিটার ও দুগ্ধবতী মায়েদের অতিরিক্ত এক লিটার পানি পান করা উচিত, কারণ আমাদের শরীর থেকে ঘাম ও শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রায় এক লিটার পানি বেরিয়ে যায়। আর শরীরের আবর্জনা বের করতে প্রায় এক লিটার প্রস্রাব হতে হয়। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি বিকল রোগীরা এক লিটার আর ডায়ালাইসিস রোগীরা ৭৫০ মিলিলিটার থেকে এক লিটার পানি পান করতে পারেন, কারণ তাদের ক্ষেত্রে প্রস্রাব কমে যায়। তবে সুস্থ মানুষের হঠাৎ করে বমি কিংবা পাতলা পায়খানা হলে হিসাব অনুযায়ী অতিরিক্ত পানি পান করতে হয়। আবার অতিরিক্ত বমি কিংবা পাতলা পায়খানা হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে গেলে কিংবা রক্তক্ষরণ হলে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে আকস্মিক কিডনি বিকল রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। যথাযথ পরিমাণ পানি পান না করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

স্থূলতা রোধ বা ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার ও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অস্বাভাবিক ওজন কিডনির গ্লোমেরুলাসের প্রেশার বাড়ায় ও দীর্ঘদিনের অতিরিক্ত চাপ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ তৈরি করে। স্থূলতা আমরা দেখি বিএমআইয়ের মাধ্যমে। আদর্শ বিএমআই হচ্ছে ১৮.৫-২৩ কেজি/(মিটার)২। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়া থাকলে ইউরিক এসিড বাড়ার ঝুঁকি থাকে আর ইউরিক এসিড বাড়লে কিডনিতে পাথর হতে পারে। রক্তে কোলেস্টেরল বাড়লে কিডনিতে রক্তপ্রবাহ কমে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।

নিয়মিত শরীরচর্চা: আমরা বলে থাকি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হাঁটা উচিত। পরপর দুদিন যেন হাঁটা বা শরীর চর্চা বাদ না হয়, সপ্তাহে ন্যূনতম তিনদিন যেন শরীরচর্চা করা হয়। শরীরচর্চার ক্ষেত্রে প্রথম ৫-১০ মিনিট হালকা জগিং করতে হবে। তারপর ৫-১০ মিনিট এমনভাবে শরীরচর্চা করতে হবে যেন মাংসপেশির ব্যায়াম হয়। আর শরীরচর্চা সম্পন্ন করার আগের ৫-১০ মিনিট ধীরে ধীরে শরীরচর্চা সম্পূর্ণ করবে। 

নিয়মিত শরীরচর্চায় মানসিক অবসাদও কমে, আবার শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল কমে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালনও বাড়বে। 

ধূমপান থেকে বিরত থাকা: ধূমপান ও মাদক সেবনে শরীরের রক্তনালিতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হয়। যার কারণে কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। অতিরিক্ত ধূমপান ও মাদক সেবনে যৌনশক্তিও লোপ পায়।

ওষুধ সেবনে সতর্ক হওয়া : প্রায়ই দেখা যায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যথার ওষুধ, অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার কারণে, বলবর্ধক সিরাপ ও বিভিন্ন হারবাল ওষুধ খাওয়ার কারণে কিডনি বিকল হয়। অপ্রয়োজনে গ্যাসের ওষুধ খেলেও হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ।

পরিমিত ভিটামিন সি খাওয়া : একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন সি প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন সি কিডনিতে পাথর তৈরি করে। পাথরের যথাযথ চিকিৎসা না করালে কিডনি বিকল হতে পারে।  তাছাড়া একসঙ্গে অনেক কামরাঙা খেলে আকস্মিক কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা আছে। 

পরিমিত লবণ খাওয়া: প্রতিদিন ৫ গ্রামের কম লবণ খাবেন (২.৪ গ্রাম সোডিয়াম)। দিনে সর্বসাকল্যে এক চা চামচ লবণ। কারণ অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার কারণে উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। যার কারণে হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ। কিডনি বিকল রোগীদের ১৫ শতাংশের কিডনি বিকলের কারণ হচ্ছে উচ্চরক্তচাপ। সুতরাং সবার উচিত পরিমিত লবণ খাওয়া।

ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা: ডায়াবেটিসের কারণে ২৪ শতাংশ রোগীর কিডনি বিকল হয়। আর উচ্চরক্তচাপের কারণে ১৫ শতাংশের। সুতরাং উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে বিশালসংখ্যক রোগীর কিডনি বিকল রোধ করা যায়। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তদের ৩২ শতাংশই জানে না যে উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। আবার যাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। একই অবস্থা ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেও। প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী জানে না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে। 

প্রস্রাব চেপে রাখা: অনেকের প্রস্রাব চেপে রাখার প্রবণতা রয়েছে, বিশেষত নারীদের মাঝে। এর আরেকটি কারণ অবশ্য আমাদের দেশে সব স্থানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের অভাব। যার কারণে নারীরা অনেক সময় বাধ্য হয়েই প্রস্রাব চেপে রাখে। এর ফলে বারবার প্রস্রাবের ইনফেকশন ও রিফ্লাক্স নেফ্রোপ্যাথি হতে পারে। 

নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা : কিডনি রোগের পাঁচটি পর্যায় বা স্টেজ রয়েছে। এক ও দুই স্টেজে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়তে দেখা যায় না। সে সময় কিডনির সর্বোত্তম পরীক্ষা হচ্ছে অ্যালবুমিন ক্রিয়েটিনিন রেশিও বা এসিআর। এসিআর পরীক্ষা করে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করালে অনেক ক্ষেত্রে কিডনি বিকল রোধ করা যায়। প্রতি ছয় মাস পর পর ক্রিয়েটিনিন করা উচিত, যদিও সবচেয়ে ভালো হচ্ছে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেশন রেট বা ইজিএফআর পরীক্ষা করা। 

লেখক: ডা. শেখ মইনুল খোকন, চিকিৎসক ও গবেষক 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫