জিইএমের প্রতিবেদন

এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তায় ঝুঁকি বাড়াবে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩

আবু তাহের

আমদানিনির্ভর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভর করে দেশে গড়ে তোলা হয়েছে অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু গত কয়েক বছরে পণ্যটি আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জ্বালানি নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করে জ্বালানি খাতের মার্কিন তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল এনার্জি মনিটর (জিইএম)।

জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া গ্যাসের ক্রমবর্ধমান মজুদ কমে যাওয়ার পরও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। চলমান এসব সংকট নিরসন না হলে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ঝুঁকি পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশকে থাকতে হতে পারে। এমন তথ্য উঠে এসেছে জিইএমের প্রতিবেদনে।

মার্কিন এ সংস্থাটি মূলত বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানিবিষয়ক তথ্য পরিষেবা দিয়ে থাকে। একই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে উৎসাহিত করতে কাজ করছে জিইএম। চলতি মাসে বিশ্বব্যাপী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা ও ক্যাপাসিটি বাড়ানোর পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দেয়া দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। ‘গ্লোবাল গ্যাস পাওয়ার এক্সপ্যানশন কন্টিনিউস টু থয়ার্ট এনার্জি ট্রান্সজেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানিয়েছে জিইএম। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা সৃষ্টি ও পরিকল্পনায় বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে অর্থ সংকট ও বিপুল অংকের বকেয়ায় পড়েছে জ্বালানি বিভাগ। কয়েক মাস আগেও তীব্র জ্বালানি সংকটে বন্ধ রাখতে হয় গ্যাসভিত্তিক অন্তত ৩০টির বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিশেষত জ্বালানি আমদানিতে অর্থ ও ডলার সংকটে পড়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে জিইএম। পরিস্থিতি উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করলেও ক্রমেই ডলার সংকট প্রকট হচ্ছে। এসব সংকট থেকে বের হতে না পারলে বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে পরিস্থিতি রয়েছে তা ২০২৬ সাল নাগাদও কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মনে করছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

আন্তর্জাতিক বাজারে যখন এলএনজির মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল, আর্থিক সংকটের কারণে তখন পণ্যটির আমদানি বন্ধ করতে বাধ্য হয় জ্বালানি বিভাগ, যা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় বড় ঝুঁকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। জিইএমের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে উঠে আসা তথ্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দেশের এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ২০২৬ সাল নয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পলিসিগত ভুলগুলো শোধরানো না গেলে এ পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে। বরং তাতে জ্বালানি খাতের অনেক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি খাতে পলিসিগত ত্রুটি রয়েছে। বিশেষত এলএনজি-নির্ভরতা এ খাতের জন্য বড় হুমকি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর রাজস্ব আয়ে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে, যা এ খাতকে আরো অস্থিরতার মধ্যে ফেলেছে। কমার্শিয়াল ও করপোরেটাইজেশন করে বেসরকারি খাতকে অতিমাত্রায় ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ২০২৬ সাল নয়, জ্বালানি খাতের আর্থিক দুরবস্থা কখনই কাটবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশ পলিসিগত ভুল করলে সেটা গবেষণার মাধ্যমে উঠে এলে তারা সেটি সংশোধন করে। কিন্তু আমরা ভুল করেছি এমনটি মনেই করি না। ফলে আর্থিক লোকসান ও দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন।’

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর কাছে তাদের পাওনাদারদের বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি (ডলারপ্রতি মূল্য ১১০ টাকা হিসেবে)। বিপুল অংকের এ দায়ের বড় অর্থ পাবে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে আইপিপিগুলোর পাওনা গত মাস পর্যন্ত ২৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকা পাবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা আদানি পাওয়ারের কাছে বকেয়া পড়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। পেট্রোবাংলার কাছে এলএনজি সরবরাহকারীদের বিল বকেয়া ৫ হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের পাওনা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।

এরই মধ্যে ডলার সংকটের কারণে জ্বালানির বিল পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে। যে কারণে আগামীতে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহতও হতে পারে। ২০ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেয়া জ্বালানি বিভাগের এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত উৎপাদন হচ্ছে না। তবে এ পরিস্থিতি দীর্ঘ সময়ে থাকবে না বলে জানিয়েছে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল। বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। 

সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকটটা বিশ্বব্যাপী। এটি শুধু আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে এটি একসময় স্থিতিশীল হবে। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াচ্ছি। নবায়নযোগ্য খাতে ক্যাপাসিটি বাড়লে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে আসবে। তবে বিদ্যুতের জ্বালানি আমদানিতে অর্থ সংকট রয়েছে এটি মানছি। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকেও বিষয়টির সুরাহা করার চেষ্টা চলছে।’

জলবায়ু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর। বিপরীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা ক্লিন এনার্জির প্রসারে গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনো জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সক্ষমতা গড়ে তুলতেই বেশি জোর দিচ্ছে বিশ্বের চীন, ব্রাজিল, ইরানসহ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশ গত এক দশকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশেষত গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ সক্ষমতা ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে। অথচ এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর মতো পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান নেই দেশে। এলএনজি ও কয়লাকে কেন্দ্র করেই এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২৮ সাল থেকে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি শুরু করলেও অস্থিতিশীল মূল্য পরিস্থিতির কারণে আর্থিক সংকটে পণ্যটি আমদানি করতে কয়েক দফা পিছু হটেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশ।

জিইএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ২০২২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সংস্কারের কাজ করেছে বাংলাদেশ। অথচ দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে সক্ষমতা রয়েছে তার অর্ধেক সক্ষমতার বেশি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। জ্বালানি সংকট ও পুরনো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনেকটাই আবার সংস্কার করতে হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক ক্যাপাসিটি সম্প্রসারণে বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে। বর্তমানে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক নতুন সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে গত অর্থবছর। বর্তমানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৫৫ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার করছে। 

দেশে প্রতিনিয়ত বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ চলে যাচ্ছে জ্বালানি আমদানিতে। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ ব্যয় করার কারণে উল্লেখযোগ্য হারে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে (বিপিএম৬) চলতি মাসের শুরুর দিকে দেশের রিজার্ভ ২৩ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ডলারের সংকট কাটাতে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে এরই মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার গ্রহণ করেছে। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫