শিক্ষাসফর

মনোমুগ্ধকর ডাংগা জমিদারবাড়িতে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩

ভ্রমণ করতে সবারই ভালো লাগে। ভ্রমণ সবসময় আমাদের নতুন কিছু শেখায়। নতুনভাবে ভাবায়। নতুনভাবে চলতে শেখায়। সময় পেলেই আমরা দল বেঁধে ছুটে যাই প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতিও আমাদের সানন্দে গ্রহণ করে নেয়। আবার তা যদি হয় ঐতিহাসিক নিদর্শন, তাহলে তো কথাই নেই। ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে কার না ভালো লাগে!

ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ ঐতিহাসিক নিদর্শনের অন্যতম বিভিন্ন জমিদারবাড়ি। ভারত উপমহাদেশে মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত জমিদারি প্রথা চালু ছিল। ওই জমিদারদের বাড়িকেই জমিদারবাড়ি বলা হতো। জমিদাররা প্রজাদের ওপর তাদের শাসনকার্য চালাতেন এ বাড়ি থেকেই। তাই জমিদারদের বাড়িগুলো প্রজাদের কাছে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছে জামিদারবাড়ি নামেই পরিচিতি পায়।

তখনকার জমিদাররা ছিলেন খুবই শৌখিন ও রুচিশীল। তাদের আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটত বিলাসবহুল দালানগুলোতে। সুনিপুণ নির্মাণশৈলীতে ফুটে উঠত কারুকার্যখচিত নান্দনিক সৌন্দর্য। শিল্প, সংস্কৃতিসমৃদ্ধ, দৃষ্টিনন্দন ও কারুকার্যময় স্থাপত্য ছিল এক অনন্য সৃষ্টি। বিভিন্ন জমিদারবাড়ি পর্যবেক্ষণ করলেই তা বোঝা যায়। বর্তমানে  বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়িগুলো। শুধু তাই নয়, প্রতিটি জমিদারবাড়ির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস।

তাই ইতিহাস জানতে, মোগল আমলের প্রতিচ্ছবি দেখতে ১৬ জুন আমরা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) কলেজ অব ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট শাখার একদল অদম্য শিক্ষার্থী ছুটে চলি ঢাকার খুব কাছেই ইতিহাসে মোড়া লক্ষ্মণ সাহার জমিদারবাড়িতে। এর অবস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাংগা বাজারের জয়নগর এলাকায়।

মোগল আমলের কারুকাজ আর পূর্ণাঙ্গ শৈল্পিক জমিদারবাড়ির নান্দনিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধনের আরেক নাম হচ্ছে লক্ষ্মণ সাহার জমিদারবাড়ি। ২৪ কক্ষবিশিষ্ট দোতলা এ বাড়ির সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। ভবনের মেঝে কষ্টিপাথর দিয়ে ঢালাই করা। ভবনটির প্রতিটি পরতে রয়েছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। মূল বাড়ির পাশেই রয়েছে ছোট একটি কারুকার্যখচিত মন্দির এবং প্রাচীন আরেকটি বাড়ি। জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে বাগান। জমিদারবাড়িসহ বাগানের চারদিক উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত। তৎকালীন মূল্যবান কষ্টিপাথরের ঢালাই দেয়া শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের পাশেই রয়েছে একটি পূজার মঠ। জানা যায়, আগে চারটি মঠ থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে বাকি তিনটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। 

কবে নাগাদ জমিদারবাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার লক্ষ্মণ সাহা এ অঞ্চলের প্রধান জমিদার ছিলেন না। মূলত তিনি ছিলেন প্রধান জমিদারের অধীন। তৎকালীন ভারতবর্ষে এলাকাটি ছিল দেবোত্তর সম্পত্তি। দেবোত্তর বলতে বোঝায় ওয়াকফ হওয়া জমি। দেবোত্তর জমি হলে জমিদারকে খাজনা দেয়া লাগত না।

জমিদার লক্ষ্মণ সাহার ছিল তিন ছেলে। নিকুঞ্জ সাহা, প্যারি মোহন সাহা ও বঙ্কু সাহা। লক্ষ্মণ সাহার মৃত্যুর পর তিন ভাই মিলে সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন। বঙ্কু সাহা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতে পাড়ি জমান। থেকে যান বড় দুই ভাই। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ার কিছু আগে নিকুঞ্জ সাহাও ভারতে চলে যান। মেজো ছেলে  প্যারি মোহন সাহাই সম্পত্তির দেখভাল করতেন। প্যারি মোহন সাহা মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিক হন তার একমাত্র সন্তান বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা। পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা অপূর্ব সুন্দর বাড়িটি বিক্রি করে দেন আহমদ আলী নামক এক আইনজীবীর কাছে। উকিল সাহেব তার স্ত্রীর নামানুসারে বাড়িটির–নাম রাখেন জামিনা মহল। আহমদ আলী সাহেব ওকালতি পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিধায় বাড়িটি জমিদার বংশের প্রতীক হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে উকিল বাড়ি হিসেবেই বেশি পরিচিত।

স্থানীয়দের থেকে জানা যায় যে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় ট্রাস্ট নামে একটি সংগঠন রয়েছে যারা এ দেবোত্তরকৃত সম্পত্তি বিক্রি করার পর আদালতে মামলা করেন। সে মামলা এখনো চলমান। মূলত মামলার জটিলতা এবং দেখভাল করার অভাবেই বর্তমানে এ সুবিশাল স্থাপত্য অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

এ দৃষ্টিনন্দন ও অপূর্ব কারুকার্যময় অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল আজ থেকে মাত্র শত বছর আগেও এটি একজন প্রতাপশালী জমিদারের বাড়ির অংশ ছিল, আর আজ তা এক পরিত্যক্ত ভগ্নাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।

উন্নত বিশ্বে যেসব স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সে স্থাপনাগুলো পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সব স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদারবাড়ি, রাজবাড়িসহ আরো কত স্থাপনা। তাদেরই একটি লক্ষ্মণ সাহার জমিদারবাড়ি। খুব কম মানুষই এ জমিদারবাড়ি সম্পর্কে অবগত। অন্যান্য জমিদারবাড়ির মতো এ বাড়িটি এখনো সবার নজরে আসতে সক্ষম হয়নি। তাই প্রশাসনিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে, পলাশের ঐতিহ্যবাহী এ জমিদারবাড়ি সংরক্ষণ করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলে দর্শনীয় স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারলে ডাংগার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব। আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ আমাদেরই করতে হবে।

ঐতিহ্যের নিদর্শন শুধু আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয়ই ঘটায় না, একই সঙ্গে আমাদের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক জীবনবোধের ধারাবাহিক রূপরেখা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন জমিদারদের স্মৃতির সাক্ষী জমিদারবাড়ি দেখে একদিকে যেমন জমিদারদের শৌর্য-বীর্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, অন্যদিকে ঐতিহ্যের অতল থেকে নিমেষে ঘুরে আসা যায়।

সময়ের পালাবদলে আজ জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু অতীতে সব জমিদারবাড়িই ছিল কমবেশি জাঁকজমকপূর্ণ। বর্তমানে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে জমিদারবাড়িগুলোর সে লাবণ্য আর নেই। তাই সবশেষে আমরা বলতেই চাই: Let’s preserve our heritage, let’s preserve our past”

আইইউবিএটির টিএইচএম অনুষদের শিক্ষার্থীদের যৌথ রচনা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫