জরায়ুমুখ ক্যান্সার

জরায়ুমুখ ক্যান্সার ভাঙতে হবে অচলায়তন

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩

অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

জননীর কাছে সবার আছে জন্ম ঋণ, জরায়ুমুখের ক্যান্সার সচেতনতায় অংশ নিন—স্লোগান নিয়ে প্রতি বছরের জানুয়ারিকে জরায়ুমুখের ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়। সমাজের যে অংশের নারীরা এতে প্রধানত আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে রোগটি নিয়ে সচেতনতার অভাব প্রচণ্ড। বিষয়টি নিয়ে লজ্জা-সংকোচ তাদের বিরত রাখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসামুখী হতে। নিম্ন আর্থসামাজিক অবস্থাও বড় বাধা। স্তন ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতায় এরই মধ্যে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। পাশাপাশি এগিয়ে নেয়া দরকার জরায়ুমুখের ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস।

রোগের ব্যাপকতা

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ছয় লাখের বেশি নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আর মারা যান ৩ লাখ ৪১ হাজারের কিছু বেশি। আড়াই লাখ মৃত্যুই ঘটে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে।

আইএআরসির হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নারী ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জরায়ুমুখের ক্যান্সার। আইএআরসির এ হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর যে সংখ্যক নারী ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তাদের মধ্যে ১২ শতাংশের রয়েছে জরায়ুমুখের ক্যান্সার। আর ক্যান্সারের কারণে নারীদের মৃত্যুর ৫ শতাংশই জরায়ুমুখ ক্যান্সারের রোগী। 

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ প্রকাশিত হাসপাতালভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীদের ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়। আর শীর্ষে রয়েছে স্তন ক্যান্সার। নারী ও পুরুষ রোগীদের সমন্বিত তালিকায় এ ক্যান্সারের অবস্থান চারে। সহজভাবে বলা যায়, প্রতি পাঁচজন নারী ক্যান্সার রোগীর একজন জরায়ুমুখের ক্যান্সারে ভুগছেন।

জরায়ুমুখের ক্যান্সার কী? 

জরায়ু বা ইউটেরাস নামক অঙ্গটির ভেতরে আমরা প্রত্যেক মানুষ জন্ম নিই। এ জরায়ুর নিচের দিকে সরু অংশটিকে বলা হয় জরায়ুমুখ, ইংরেজিতে সারভিক্স। এ সারভিক্সের ক্যান্সারকে বলা হয় সার্ভিক্যাল বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার। পুরো জরায়ু থেকে জরায়ুমুখের ক্যান্সার একটু ভিন্ন প্রকৃতির। 

জরায়ুমুখের ক্যান্সারে একজন নারী আক্রান্ত হয় কেন?

জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে কতগুলো আর্থসামাজিক ও কিছু ব্যক্তিগত কারণ রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের বেলায় যেখানে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা বেশির ভাগই একটু নিম্ন পর্যায়ের থাকে, আমরা প্রধানত দায়ী করি বাল্যবিবাহকে। খুব অল্প বয়সে যদি মেয়েদের বিয়ে হয় ও অল্প বয়সে সন্তান হয়, যদি বেশি সন্তান হয়, সন্তান ঘন ঘন হয় তাহলে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এগুলো অন্যতম প্রধান কারণ। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব। বিশেষ করে মাসিকের সময় জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় না থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। অপুষ্টি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে অন্য কারণগুলোকে উৎসাহিত করে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে মেলামেশা। আমাদের দেশে সমস্যাটি বাড়ছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এ হার বেশি। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) ভাইরাস এ ক্যান্সারের জন্য প্রধানত দায়ী। এ ভাইরাসের সংক্রমণ যদি বারবার হয়, তাহলে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। 

জরায়ুমুখে এইচপিভি ভাইরাসের সংক্রমণ কী করে হয়?

শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে মূলত এ ভাইরাস ছড়ায়। একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে মেলামেশা বয়ে আনতে পারে নারীর জন্য এ ভয়াবহ বিপদ। বিপথগামী স্বামী কিংবা পুরুষ সঙ্গীর কারণে একজন নারী আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া এইচপিভি ভাইরাসের কারণে শরীরের অন্যান্য জায়গায়ও সংক্রমণ হয়।

জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?

মাসিকের রাস্তায় অতিরিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব যাওয়া। মাসিকের রাস্তায় অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি কয়েক রকম হতে পারে। যেমন প্রতি মাসে নারীদের মাসিকের সময়কাল যদি হঠাৎ করে বেড়ে যায়, যে পরিমাণ রক্ত সাধারণত যায়, এর থেকে যদি বেশি পরিমাণ রক্ত যাওয়া শুরু হয়। মাসের মাঝখানে যদি আবার এ রকম রক্তক্ষরণ হয়। মেনোপজ অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর, যদি হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর যদি রক্তক্ষরণ হয় বা ব্যথা হয়—এগুলো হলো প্রধান লক্ষণ। তবে রোগটি যখন একটু অগ্রসর হয়ে যায়, যখন আশপাশের গঠনগুলো আক্রান্ত হয়ে যায়, তখন ধীরে ধীরে আরো কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন তলপেটে ব্যথা হতে পারে। তারপর প্রস্রাবের রাস্তার সঙ্গে, পায়খানার রাস্তার সঙ্গে এটি যুক্ত হয়ে যেতে পারে। এ রকম খুব বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। 

প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয়

জরায়ুমুখের ক্যান্সারের বেলায় একটি বিশেষ আশাবাদের জায়গা আছে। আমরা জানি কোষের মধ্যে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে হতে এক পর্যায়ে ক্যান্সার হয়। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের বেলায় প্রথম প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর পর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে পূর্ণাঙ্গ বা আগ্রাসী ক্যান্সারে রূপ নিতে। লক্ষণ দেখা দেয়ার আগেই এ ক্যান্সার আমরা নির্ণয় করতে পারি। এখানে দুটো প্রধান পরীক্ষা রয়েছে। প্যাপটেস্ট, যাকে গোল্ডস্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়। আরেকটি হলো ভায়া টেস্ট, ভিআইএ। এ পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে ক্যান্সার স্ক্রিনিং করা যায়।

ক্যান্সার স্ক্রিনিং 

জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ত্রিনিংয়ের জন্য ওপরে দুটি পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। এ পরীক্ষা দুটি নিয়ে কোনো আতঙ্ক বা ভয়ভীতির কিছু নেই। একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ যেভাবে একজন নারী রোগীকে পরীক্ষা করেন, অনেকটা সেই রকম।

প্যাপটেস্ট

একটি কাঠের কাঠির মতো, আইসক্রিমের সঙ্গে যেমন চামচ দেয়া থাকে, অনেকটা সে রকম দেখতে ‘স্প্যাচুলা’র সাহায্যে জরায়ুমুখের ভেতর থেকে কষ এনে তা দিয়ে স্লাইড বানিয়ে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয় কোনো অস্বাভাবিক বা ক্যান্সার সেল আছে কিনা! কোনো কাটাছেঁড়ার দরকার হয় না।

ভায়া টেস্ট 

এ পরীক্ষা আরো সহজ। প্রায় নিখরচায় এটি করা সম্ভব। প্যাপটেস্টের মতোই রোগীকে প্রস্তুত করে ৩-৫% অ্যাসিটিক এসিড ভেজানো একটি সোয়াবস্টিক (মাথায় তুলা লাগানো কাঠি) জরায়ুমুখের ভেতর দিকে স্পর্শ করে এক মিনিট পর পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোনো সাদা দাগ পড়লে ভায়া পজিটিভ, না পড়লে নেগেটিভ। এখানেও কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না। মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে স্লাইড দেখার প্রয়োজন না হওয়ায় সামান্য খরচে অনেকের পক্ষেই এ পরীক্ষা করা সম্ভব। তবে ভায়া পজিটিভ হলেই জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত, না হলে একেবারেই বিপদমুক্ত, এমনটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। পরে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসা

সাধারণত চারটি পর্যায়ে আমরা বিষয়টিকে ভাগ করি—১, ২, ৩ ও ৪। এর মধ্যে আবার এ, বি করে ভাগ করা হয়। যখন স্টেজ বা পর্যায় ২-এ পর্যন্ত থাকে, তখন প্রধান চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেয়া। পরে যদি অন্যান্য চিকিৎসা লাগে সেগুলো করা হয়। এ চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। এটি হলো একটি আশার দিক। আর যদি দেরি হয়ে যায় বা ওই পর্যায়টি পার হয়ে যায়, তখন হয়তো সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার করা যায় না। রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি দিয়ে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করার পর, আবার অস্ত্রোপচারের দিকে যাওয়া যায়। যত আগে ধরা পড়বে তত লাভ। আগে ধরা পড়লে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ রোগে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে এসব বিষয়ে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

ভাঙতে হবে অচলায়তন

সংকোচের বিহ্বলতা কাটাতে হবে। আমাদের সামাজিক ধর্মীয় বিষয় মাথায় রেখে প্রাণঘাতী এ রোগ নিয়ে আলোচনা করাটাও অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য। অনেকে ভেতরে ভেতরে রোগটি পুষতে থাকেন। লক্ষণ টের পেলেও পরিবারের সদস্যদের কাছেও গোপন রাখেন। শেষ পর্যায়ে যখন চিকিৎসার জন্য আসেন, তখন আর করার কিছু থাকে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারীদের প্রধান দুটি ক্যান্সারের স্থান, অর্থাৎ স্তন ও জরায়ুর সুস্থতা নিয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের নারীদের বুঝতে হবে, স্তন কিংবা জরায়ু একজন নারীর জন্য, একজন মায়ের জন্য লজ্জা বা সংকোচের কোনো বিষয় নয়। যে অঙ্গে মা তার সন্তানকে ধারণ করেন, সেই জরায়ু, কিংবা জন্মের পর যে অঙ্গ থেকে সন্তানকে পুষ্টি জোগান, সেই স্তন বরং একজন মায়ের জন্য অহংকারের বিষয়। এর সুস্থতা নিয়ে নারীকে কথা বলার সাহস জোগাতে হবে। প্রতিটি পুরুষের দায়িত্ব তার জননীর, নিজের কিংবা তার সন্তানের জন্য জরায়ুর সুস্থতা নিশ্চিত করা। জননীর কাছে জন্ম ঋণ স্মরণ করে।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগ

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউিট ও হাসপাতাল


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫