ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল

স্বল্প খরচে আধুনিক সেবা মেলে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩

শর্মিলা সিনড্রেলা

সরকারি হাসপাতাল বলতেই অনেকের মনে কিছু বদ্ধমূল ধারণা থাকে। অপরিচ্ছন্নতা, মেশিন নষ্ট, সেবা পেতে দেরি হওয়া আর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রভাব—শব্দগুলো যেন আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে দেশের বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে। সে ধারণার আমূল পরিবর্তন এনে দেবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল (এনআইএনএস)।

২০১২ সালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে হাসপাতালটি যখন তৈরি হয় তখন জায়গাটা ছিল খুব অনিরাপদ। ছিনতাই আর দুর্ঘটনা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সেই অনিরাপদ জায়গায় গড়ে তোলা হাসপাতালটির আউটডোরেই এখন প্রতিদিন দেড়-দুই হাজার রোগী সেবা নিচ্ছে। ভেতরেও কখনো বেড খালি থাকে না। তাছাড়া আগে মানুষ বুঝতেই পারত না যে তার নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হয়েছে। এখন মানুষ যদি দেখে তার মাথাব্যাথা হচ্ছে, মৃগীরোগ হচ্ছে, স্ট্রোক হয়েছে তাহলে খুঁজে খুঁজে এখানে চলে আসে। এমন সব প্রতিকূলতার মধ্যে হাসপাতাল চালু করা ও সক্ষমতার বাইরে গিয়ে জনগণের সেবা নিশ্চিত করায় সবার কাছে ছড়িয়ে পড়ছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের নাম। 

শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার নিউরোলজিক্যাল যেকোনো রোগের চিকিৎসা মেলে এ হাসপাতালে। সকাল থেকেই হাসপাতালে শুরু হয় রোগীর চাপ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা ছুটে আসেন এখানে সেবা নিতে। সকালে আউটডোরে দেখার পরে প্রয়োজনে বিকালে নেন বিশেষজ্ঞ সেবা। তারপর দরকার পড়লে ভর্তি হওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অপারেশন সবই হয় এ হাসপাতালে। আর এসবই রোগীরা করাতে পারেন খুব কম খরচে। 

৪৫০ শয্যার এ হাসপাতালে নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি, পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি, পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জারি ইত্যাদি বিভাগ রয়েছে। আরো রয়েছে অপারেশন থিয়েটার, ক্যাথ ল্যাব, ল্যাবরেটরি সার্ভিস ও আইসিইউ সেবাও। 

এছাড়া রয়েছে মাথাব্যথা, এপিলেপসি, মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার ক্লিনিক। ১০০ শয্যার স্ট্রোক ইউনিটে রয়েছে সব ধরনের অত্যাধুনিক চিকিৎসা। এনআইএনএসের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো বদরুল আলম বলেন, ‘‌আমাদের স্ট্রোক ইউনিটের বৈশিষ্ট্য হলো যদি কোনো রোগী স্ট্রোক হওয়ার সাড়ে চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে এখানে আসে তাহলে অ্যান্টিপ্লেজ ইনজেকশন দেয়া হয়। যদি সময়মতো প্রাথমিকভাবে রোগী নির্বাচন করে এ ইনজেকশন দেয়া যায় তাহলে রোগীর পঙ্গুত্ব লাঘব করা যায়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ফলে। এখানে স্ট্রোক ফিজিশিয়ান, নিউরোফিজিশিয়ান, ইন্টারভেনশনিস্টরা দেশের বিভিন্ন স্থান ও দেশের বাইরের নানা জায়গায় ট্রেনিং করে এসে কার্যক্রম পরিচালনা করে।’

নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের বিশেষ স্ট্রোক ইউনিটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানে রোগীর কোনো অ্যাটেনডেন্ট থাকতে হয় না। রোগীর যাবতীয় দায়িত্ব এখানকার স্টাফ, ডাক্তার, নার্সরাই পালন করেন। তারাই রোগীকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে সার্বিক যত্ন করে থাকেন। বদরুল আলম বলেন, ‘‌এটি একটি মডেল ওয়ার্ড। বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর অ্যাটেনডেন্ট থাকার কারণে ডাক্তারদের সঙ্গে নানা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এ হাসপাতালে আজ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা আমরা পাইনি। সেটা সব জায়গায় অনুসরণ করা গেলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হতো।’

পাশাপাশি এ হাসপাতালে চেষ্টা করা হয় গুণগত মান বজায় রাখার। এনআইএনএসের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজির অধ্যাপক ও এক্সপানশন প্রজেক্টের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডা এমএস জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‌আমরা সবসময় চেষ্টা করি হাসপাতালের গুণগত মান রক্ষার ও চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার। যন্ত্রপাতি নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রাখি, অপারেশন থিয়েটার জীবাণুমুক্ত রাখি। অনেক হাসপাতালে মেশিন অকেজো পড়ে থাকে। ১০ বছরের বেশি হয়েছে, এ হাসপাতালে কখনো সিটি স্ক্যান বা এমআরআই মেশিন নষ্ট হয়নি। কারণ সেগুলো নিয়মিত মেইনটেইন করা হয়।’

নিউরোলজি বা নিউরোসায়েন্সে বিশ্বে যত সব আধুনিক চিকিৎসা আছে তার সব এখানে মেলে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের সহকারী অধ্যাপক এটিএম হাসিবুল হাসান বলেন, ‘স্ট্রোক প্রতিরোধে রক্তনালিতে ব্লক ছাড়িয়ে দেয়ার কাজও আমরা করে থাকি একেবারে স্বল্প মূল্যে। আরেক ধরনের সিভিয়ার স্ট্রোক রোগীর প্রথম ৬০ দিনে মৃত্যুঝুঁকি থাকে ৬০ শতাংশ। সেখানে খুলি কেটে অপারেশন করা যায়, আবার খুলি না কেটেও করা যায়। এ দুটিই এখানে করা হয়। ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিকেরও এ হাসপাতালে অত্যাধুনিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় সরকারের সহযোগিতায়। যে অপারেশন করতে বাইরে ২০-২৫ লাখ টাকা লাগে এখানে সেটা ৩-৪ লাখ টাকায় করা সম্ভব। আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে কোলাবরেশনে এ হাসপাতালে ব্রেইনেও বাইপাস করা হয়েছে। অত্যাধুনিক বিশ্বে হয় কিন্তু এখানে হয় না, এমন কিছু নেই।’

বিদেশে সরকারি চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ থাকে। এখানে সেই ইন্স্যুরেন্স কাভারেজও নেই। উপরন্তু দেশে এর একটা অর্থনৈতিক প্রভাব আছে। এটিএম হাসিবুল হাসান বলেন, ‘‌বছরে আমরা ইন্টারভেনশনে প্রায় ৪০০ রোগীর অপারেশন করি। যদি দেশে অপারেশন না হতো তাহলে তারা বিদেশে যেত। তাতে গড়ে ১০ হাজার ডলার করে হলেও সেটা বাইরে চলে যেত। এভাবে নিশ্চয়ই মিলিয়ন ডলার বেঁচে যাচ্ছে। পরোক্ষভাবে এর প্রভাবটা আরো বেশি।’

এ হাসপাতালে একই সময়ে ছয়টা ওটিতে কাজ করা হয়। একই চিকিৎসা বিভাগীয় শহরগুলোতে ছড়িয়ে দিতে পারলে তা দেশের মানুষের আরো উপকারে আসবে। এটিএম হাসিবুল হাসান বলেন, ‘‌অনেক দেশই হেলথ ট্যুরিজমে মনোযোগ দিচ্ছে। সেখানে চাকচিক্য প্রাধান্য পাচ্ছে, ভেতরে কি আছে না আছে কেউ দেখছে না। এর ওপরই মূলত এই হেলথ ট্যুরিজম দাঁড়িয়ে আছে। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা। জনগণের সেই মনস্তত্ত্বে পরিবর্তন আনতে হবে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫