১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মের ভিত্তিতে যে দুই রাষ্ট্র গঠিত হলো, সেখানে আমাদের ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ধারণাটিকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার আরম্ভ। সে সময়ে সমগ্র উপমহাদেশের শিল্পচর্চার জন্য গড়ে ওঠা কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জয়নুল আবেদিনের যুক্ততা ছিল গভীর। ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকায় স্বতন্ত্রভাবে শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন, যা ছিল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট। শিল্পাচার্যর এ ভাবনার পেছনে পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলে শিল্পশিক্ষার স্কুল না থাকার শূন্যতাবোধ মৌলিকভাবে কাজ করেছিল। সে সময়ে কলকাতায় গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে যেসব মুসলমান শিক্ষক ছিলেন, তাদের একত্র করে শিল্পাচার্য ঢাকায় নিয়ে আসেন। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, খাজা শফিক আহমেদ, কামরুল হাসান প্রমুখ।
চল্লিশের দশকে তখন কলকাতায় চলছিল নব্যবঙ্গীয় শিল্পরীতির চর্চা। অর্থাৎ ইতিহাস, পুরাণ ও ধর্মনির্ভর চিত্রচর্চা। ঢাকার শিল্পীরা এ ধারার বাইরে গিয়ে ভিন্নপথে তাদের শিল্পচর্চা আরম্ভ করেন। তাদের বিষয়বস্তু সাধারণ অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়েছিল বলেই দেখা যায় এর সঙ্গে বাংলার গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি মিশে গিয়েছিল। ঢাকাভিত্তিক এ শিল্পীদের কাজে আমরা যেমন নগরজীবনকে দেখতে পাই না, তেমনি বিশেষ নব্যবঙ্গীয় ধারার প্রভাবও পাই না। এ সময়ের শিল্পীরা ইউরোপীয় শিল্পধারা ও নানা রীতিকে প্রাধান্য দিলেও তাদের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ এ অঞ্চলের জীবনযাত্রা থেকে নেয়া।
আমরা দেখতে পাই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিমূর্ততা অর্থাৎ পশ্চিম প্রচলিত অ্যাবস্ট্রাক্ট ধারাকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের অঞ্চলে নতুন একটা রীতি সূচনা হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কলকাতায় অবস্থানকালেই বাস্তবধর্মিতাকে প্রাধান্য দিয়ে যে দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা এঁকেছিলেন এবং বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়েও শিল্পাচার্য তার এ যাত্রা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। পশ্চিমের শিল্পধারা সে সময়ে যেহেতু জোরালোভাবে ক্রিয়াশীল হচ্ছে, জয়নুলের শিল্পভাবনা বা রীতি, প্রকরণে এ ধারার যোগসূত্র ছিল। তবে একই সঙ্গে জয়নুল আবেদিন আমাদের লোকশিল্প, লোকঐতিহ্যের অনুষঙ্গকে তার ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন নানা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে। তার এ প্রবণতা আমাদের শিল্পচর্চার ধারাকে বৈচিত্র্যময় করে। জয়নুলের উদ্ভাবিত বলিষ্ঠ রেখার সঙ্গে লোকশিল্পের প্রকরণের মিশ্রণ আমাদের এখানকার শিল্পধারার প্রধান এক বৈশিষ্ট্য।
এ সময়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ। তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ঢাকার শিল্পশিক্ষক হিসেবে। তিনি ছিলেন জয়নুল আবেদিনের প্রধান একজন সঙ্গী। ছাপচিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি এ দেশের চিত্রচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা তার ছবিতে নব্যবঙ্গীয় রীতি ও পশ্চিমের বাস্তবানুগ ধারার সংমিশ্রণ দেখতে পাই। সফিউদ্দীন আহমেদ কলকাতার নগরজীবনে বেড়ে উঠেছিলেন। সেখান থেকে পূর্ববঙ্গে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করলে তার ছবিতে পরিবর্তন আসে। তার ছবিতে যে দিগন্তবিস্তারী বাংলার নিসর্গ, জলরাশি, সাধারণ মানুষ আমরা দেখতে পাই, তা আমাদের শিল্পচর্চার জন্মলগ্নকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ করেছে। পরবর্তী সময়ে সফিউদ্দীন আধাবিমূর্ত ও জ্যামিতিক ধারার সংমিশ্রণে বাংলার লোকশিল্পের নানা মোটিফকে তার কাজে যুক্ত করে চলেছিলেন।
ঢাকাভিত্তিক শিল্পচর্চার শুরুর সময়টাকে বুঝতে গেলে শিল্পী আনোয়ারুল হক ও খাজা শফিক আহমেদ এ দুজনের নাম বিশেষভাবে সামনে আসে। এ দুই শিল্পীই ইউরোপীয় ধারার চর্চার মাধ্যমে ঢাকার শিল্পশিক্ষায় নানাবিধ পরিবর্তন এনেছিলেন। আনোয়ারুল হক তেলচিত্রকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি বাস্তবানুগতাকে অতিক্রম করে কিছুটা সুররিয়াল, কিছুটা অ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ততার পথে এগিয়েছিলেন। যদিও তার বিষয়বস্তু হিসেবে আমরা নিসর্গ, জড়জীবন, প্রতিকৃতি এসবই দেখতে পাই। অন্যদিকে খাজা শফিক জলরঙ ও গোয়াশ মাধ্যমে চিত্রচর্চা করেছেন। তিনি বিশেষ করে এ অঞ্চলের সমাজ জীবনের নানা উৎসবকে কেন্দ্র করে এঁকেছেন।
আমাদের প্রধানতম শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রমালায় আমরা মূলত বাংলার জনমানুষ, প্রকৃতি, দেশমাতৃকা, সংস্কৃতি, নারী ইত্যাদির প্রাধান্য দেখতে পাই। ইউরোপীয় ধারার সঙ্গে নব্যবঙ্গীয় ধারার প্রভাব তার ছবিতে ছিল। বিশেষ করে ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে তার অল্প বয়সের যুক্ততা ও জীবনভর তার চর্চা, অন্যদিকে জয়নুল আবেদিন ও যামিনী রায়ের চিত্রকলার প্রতি তার অনুরাগ কামরুল হাসানকে এক নতুন শিল্পশৈলীর সন্ধান দিয়েছিল। এ সবকিছু মিলিয়ে ঢাকার শিল্পচর্চায় চিন্তা ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার জায়গাগুলোকে তিনি পরিপূর্ণ করে তোলেন। বাংলার লোকশিল্প থেকে অনুষঙ্গ-উপাদানকে একত্র করে তার যে নিজস্ব চিত্রভাষা তৈরি হয়েছিল, তা এখানকার শিল্পকলার মৌলিক সম্পদ। জলরঙ, তেলরঙ, গোয়াশ, অ্যাক্রিলিক, কাঠ খোদাইসহ বিভিন্ন মাধ্যমকে তিনি তার চিত্রতলে ব্যবহার করেছেন।
আমাদের শিল্পচর্চায় এ শিল্পীরা আমাদের পথনিদের্শক হিসেবে এসেছিলেন। আমাদের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার প্রাক্কালে আমরা যাদের দেখেছি তাদের মধ্যে আছেন আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, কাজী আবদুল বাসেত, নিতুন কুন্ডু প্রমুখ। শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া কলকাতা থেকে শিল্পশিক্ষা সমাপ্ত করে ঢাকায় এসেছিলেন।
এ শিল্পীরা অনেকে ঢাকায় লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন। আমিনুল ইসলাম গিয়েছিলেন ইতালিতে, হামিদুর রহমান ইংল্যান্ডে, রশীদ চৌধুরী স্পেন ও ফ্রান্সে, মুর্তজা বশীর ইতালিতে, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আবদুল বাসেত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া জাপানে। শিল্পীদের এ বিদেশে শিক্ষাগ্রহণ আমাদের দেশে প্রশস্ত শিল্প ধারণা তৈরি করেছিল এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করেছিল।
পশ্চিমের আধুনিক শিল্পধারার নানা বৈশিষ্ট্য, চিত্ররীতির বিচিত্র সম্ভার, ধরনধারণ আমাদের শিল্পকলায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। বিশেষত পশ্চিমের প্রচলিত অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম। এর বাইরে কিউবিজম, সুররিয়ালিজম, রোমান্টিসিজম ও অন্যান্য রীতির প্রভাবও এ দেশে দেখা যায়।
পঞ্চাশের দশকে শিল্পের বিষয়বস্তুতে দেশীয় নানা উপাদান-উপকরণ, দেশীয় প্রেক্ষাপট, লোকজ মোটিফ আমরা তেমন দেখতে পাই না। মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, দেবদাস চক্রবর্তী, আবদুল বাসেত প্রমুখ শিল্পী সম্পূর্ণভাবে বিমূর্ত ধারায় নিজেকে স্থিত করেন। অন্যদিকে হামিদুর রহমান, মুর্তজা বশীর কখনো বিমূর্ত, কখনো আধা-বিমূর্ত এমন ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়ে তাদের শিল্পচর্চা পরিচালিত করেছেন।
মূলত জৈবিক অভিজ্ঞতা, শিল্পের প্রকরণ, উপাদান, গঠন, বিন্যাস, ফর্মের ভাঙন-গড়ন, টেক্সচার, রঙ-রেখার দক্ষতা, চিত্রতল নির্মাণ কৌশল, শৈলী, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যালোচনা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সংবেদনশীলতা, আন্তর্জাতিক শিল্পের প্রভাব, ধরনধারণ, ব্যক্তিস্বতন্ত্রতা, কখনো নব্য আধুনিক শিল্পধারার পক্ষে, কখনো ঐতিহ্যবিমুখতা, অনুসন্ধানের ব্যাপকতা, আঞ্চলিক শিল্পধারা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, আধুনিক মানবমনের প্রতিরূপ সন্ধান প্রভৃতির সংশ্লেষণ এ অঞ্চলের শিল্পধারা তৈরিতে প্রভাবক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
এসব শিল্পী ও শিল্পশিক্ষক প্রত্যেকে যার যার নিজস্বতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত শিল্প সৃজনের পাশাপাশি বাংলাদেশে শিল্পের ধারা তৈরির পাটাতন তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তারা এ দেশের শিল্পকলায় একটি ছন্দময় ও বৈচিত্র্যপূণ ঐক্যসূত্র তৈরিতে সচেষ্ট অবদান রেখেছেন। আমাদের রাষ্ট্র নির্মাণের টানাপড়েনের বাস্তবতায় শিল্পশিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ, পাশাপাশি নিজস্ব শিল্পধারা তৈরির প্রচেষ্টা, সর্বোপরি জাতীয় জাগরণে নেতৃত্বের ভূমিকা–এসব যুগান্তকারী দায়িত্ব পালন করে গেছেন আমাদের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা।