প্রদর্শনী

সময়ের শুরুর কথা

প্রকাশ: আগস্ট ৩০, ২০২৩

ওয়াহিদ সুজন

কামরুজ্জামান সাগরের চিত্রকর্মে মানুষ আছে। একা। পাখি বা হরিণ আছে। একা। যৌথ বিচরণের মাঝেও একা। পৃথিবী ও সমূহ জীবনের বিপন্নতার প্রতীক এ একাকিত্ব। রঙ ও ভঙ্গিতে উজ্জ্বল ও মনোহর। আছে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ; এক-একটি দরোজা যেন। জগতের বাস্তবতা ভেঙে বিশ্লিষ্ট হয়ে উঠছে। কী নিদারুণ এক ধাঁধাময় চিত্রজগৎ। যে বিপন্নতার ভেতর আমরা নিরাশা দেখি, আবার ঘুরে দাঁড়ানোর ইশারাও রাখি। আমাদের প্রকৃতিবিনাশী সভ্যতার শেষ প্রান্তে দাঁড় করান সাগর। আবার এও দেখান, পৃথিবীকে সারিয়ে তোলা ছাড়া প্রকৃতির কোনো বিকল্প নেই। 

‘৭৯ গ্রাফিকস’ শিরোনামে কামরুজ্জামান সাগরের একক প্রদর্শনী চলছে উত্তরার গ্যালারি কায়ায়। এখানে লিথোগ্রাফি মাধ্যমে করা ৭৯টি চিত্রকর্ম ঠাঁই পেয়েছে। শিরোনামে কোনো ইঙ্গিত না থাকলেও থিম ও আঁকার ধরন একই লক্ষ্যকে নির্দেশ করে। একই ধরনের প্রতীক ও সাদৃশ্য ব্যবহারে একটি ছবির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক ধরে পুরো প্রদর্শনীর সামগ্রিক অবয়ব কল্পনা করা যায়। 

প্রকাশিত ক্যাটালগে ভূমিকা লিখেছেন শিল্প সমালোচক তকির হোসেন। বাংলায় যার শিরোনাম দাঁড়ায় ‘মানবজীবনের জটিলতার সঙ্গে পরাবাস্তববাদী রূপকের সংমিশ্রণ’। তার কথা অনুসরণ করলে শিল্প ও কল্পনা একে অপরের খুব কাছাকাছি। কল্পনা অনেক উৎস হতে পারে এবং এটি এমন এক ক্ষমতা যা শিল্পীকে তার মনের মধ্যে এমন অনুভব আনতে পারেন, যা একদম নতুন ও উত্তেজনাপূর্ণ। যার প্রকাশ ঘটে শিল্পকর্মে। কামরুজ্জামান সাগরের শিল্পকর্ম কল্পনাশক্তির মননশীল আভাস দেয়। অবচেতন মনে খেলা করা চিত্রগুলো তিনি ক্যানভাসে তুলে এনেছেন। এ চিত্রগুলো মানুষের যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখে অচেতনের শক্তিকে জাহির করে।

শিল্পে অবচেতনের সঙ্গে বাস্তবতার জটিল সমীকরণ আমরা বারেবারে শরণে নিই। মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনার প্রধানতম অনুষঙ্গ উদ্বিগ্নতা, অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কা। অনিশ্চয়তা। মানুষ নিজেকে যতটা বুঝেছে বা প্রকৃতিসমেত তার যে যাত্রা, ততটা সে অনিশ্চিত হয়েছে। আর তকির হোসেনের লেখা থেকে শিল্পীর শৈশব ও বেড়ে ওঠার যে গল্প আছে তাতে বোঝা যায় জীবনে হারানোর যে বেদনা, তার নিরাময় শুধু অর্জন দিয়ে হয় না, বরং জীবন ও জগতের বোঝাপড়ার মাঝে এই নিরাময় নিহিত। সাগর তার চিত্রকর্মে মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশকে ধ্বংসস্তূপের মাঝে এঁকেছেন। সেই চিত্র ধ্রুপদি ঘরানার অলংকরণ ও অবয়বের মাধ্যমে চিরন্তন মেটাফোর তৈরি করেছে। যেখানে প্রতীকীভাবে পরাজগৎ এসেছে। যার আড়ালে আছে সময়। তার চিত্রকর্মকে চলমানতা দিয়েছে অতি ব্যবহৃত ফোঁটা ফোঁটা জল। না, তা যেমন জলের ফোঁটা হতে পারে, আবার হয়ে উঠতে পারে জীবনের প্রথম আভাস ভ্রূণ। তবে সময় নিজেও হাজির হতে পারে। সময় যে বহমান জগতের আত্মা। সাগরের ছবির বহমানতা উন্মূল মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। এখন আলাদা করে নগরের নাম নিতে হয় না। কারণ ঢাকা বা অ্যামাজন উষ্ণ হয়ে ওঠার ঘটনা যে এক সূত্রে আমার এরই মধ্যে জেনেই গেছি। 

মানুষ প্রকৃতিকে বিপন্ন করছে। আবার প্রকৃতিই নিজেই নিজেকে সারিয়ে তোলে। কিন্তু মানুষের আত্মসচেতনতার স্তরে না দাঁড়ালে তা বোঝা সম্ভব না। তাই এই যৌথতা সম্ভাবনা আকারে থাকে। এবং মানুষের পাশাপাশি সাগরের কাজে পাখি এসেছে বেশি। মানুষের ধ্বংসের চেয়ে কোমল-পেলব পাখির পালক উড়তে বেশি দেখি। মানুষের পাখি হওয়া ছাড়া কোনো সম্ভাবনা কি নেই! ‘টাইম অব ডিফিকাল্টি’ ছবিতে আমরা পরিবর্তনের মাঝে তুমুল ভাঙন দেখি, আবার ‘রেস্টোরেশন অ্যাগেইন’-এ নিরাময় দেখি। ‘সারভাইভাল মোমেন্ট’, ‘বার্নিং ফরেস্ট’ বা ‘ইন্সপিরেশন’-এর ছবি কল্পনার ভিন্নতার মাঝেও নিরাময় দেখায়। এভাবে সময়কে দেখার মাঝে সেইসব চিহ্ন আছে, যার কারণে আমরা সময়কে অস্বীকার করতে পারি না। আবার সময় যেন নিজেকে শুরু করে। আর আমাদের গল্পগুলো যেন নিরন্তন পৃথিবীর জন্মের গল্প। 

কামরুজ্জামান সাগর কাজের ক্ষেত্রে ভীষণ সংযমী। লিথ টেকনিকের সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো ভালোমতো কাজে লাগিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন স্পেসের ব্যবহার বা একে নির্ঝঞ্ঝাট রেখে বিষয় সৃষ্টিতে পারঙ্গম তিনি। কিছু ছবিতে শুধু সাদা-কালোর ব্যবহার শক্তিমত্তার লক্ষণ হিসেবে এসেছে। আবার লাল-নীল বা সোনালির নানা স্তরের ব্যবহার বিপন্নতার ভিন্ন লেয়ার তৈরি করেছে। 

সাগর দেখান, কভিডের মতো মহামারী দুনিয়াকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। নিজের আবির্ভাব থেকেই মানুষ প্রায় দুনিয়ার সব দুর্দশার সঙ্গে সম্পর্কিত। তার দেখাদেখি মানবকেন্দ্রিক হলেও তা বোধহয় সরানো যে দরকার, সেটা বোঝার সময় যে একদম ফুরিয়ে যায়নি এমন নয়। কামরুজ্জামান সাগরের কাজে সেই আশাটুকু পাখি হয়ে বসে থাকে। যেখানে ধ্বংসস্তূপের মাঝে অটুট থাকে পাখির ঘরটুকু। তার জন্য আদর্শ একটি জগৎই হতে পারে সবার বসবাসের উপযোগী। এ যূথতায় পাখি হলো মেটাফোর। যার পালক হলো সময়। আর সময় নতুন নতুন শুরুর গল্প। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫