মহামারীতে রূপ নেয়ার পথে রয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। এরই মধ্যে ডেঙ্গু রাজধানীর সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল বিভাগে। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে একে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ডেঙ্গুর এ অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিকে ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে সেটিকে পুরোপুরি মহামারী বলা না হলেও এর দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বুধবার (১৯ জুলাই) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৯২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় মোট ভর্তি হওয়া রোগী ১৬ হাজার ৩৯৮ জন। দেশের অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৯ হাজার ৩৯৪ জন। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা চলতি বছরে ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ সময়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৭৯২ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১৪৬।
চলতি বছরের
১ জানুয়ারি থেকে বুধবার (১৯ জুলাই) পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে
২০ হাজার ৯৪ জন। এর মধ্যে ঢাকায় মোট ছাড়প্রাপ্ত রোগী ১২ হাজার ৯১৫ জন। ঢাকার বাইরে
মোট ছাড়প্রাপ্ত রোগী ৯ হাজার ১৭৯ জন। আর বর্ষাকালে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়।
এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। সতর্ক না হলে শিশু থেকে সব বয়সী মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে
পারে। ডেঙ্গুর সবচেয়ে ঝুঁকি হচ্ছে রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া। শিশুসহ যাদের রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের এতে মৃত্যুঝুঁকি আছে।
ডেঙ্গু রোগ মশার কামড়ে ছড়ায়। তাই এগুলো সাধারণত বর্ষাকালে হয়, যা মশার বেঁচে থাকা এবং প্রজনন উভয়কেই সাহায্য করে। জ্বর সেরে গেলেই শুরু হয় বিপর্যয়। একে বলা হয় সংকটপূর্ণ সময়। এ পর্যায়ে হতে পারে ডেঙ্গুজনিত রক্তক্ষরণ ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। বমি, পেটব্যথা, অস্থিরতা বা অলসতা এবং যেকোনো স্থান থেকে রক্তপাতের মতো সতর্কতা চিহ্নসহ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের একটি বড় অংশই শিশু। শিশুরা সাধারণত তাদের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন বা সতর্ক না হওয়ার কারণে তাদের ওপর এ রোগের প্রভাব বড়দের চাইতে আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ অবস্থায়
শিশুদের ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় মা-বাবা বা অভিভাবকদেরকেই সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্বশীল
ভূমিকা রাখতে হবে। আর চারদিকে যেহেতু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, তাই এ সময়ে শিশুর জ্বর
এলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।
শিশুর
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ
সাধারণত
ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা কামড় দেয়ার পর সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে
পড়ে। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। তবে
শিশুর জ্বর মানেই যে সেটা ডেঙ্গু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
১. ডেঙ্গু
যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এ রোগে জ্বরের তাপমাত্রা
সাধারণত ১০১, ১০২ ও ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে। তবে
ডেঙ্গু হলেই যে তীব্র জ্বর থাকবে, এমনটা নয়। জ্বর ১০০-এর নিচে
থাকা অবস্থায়ও অনেক শিশুর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
প্রথমত,
ফেব্রাইল ফেজ: শিশুর ডেঙ্গু জ্বর দু-তিনদিন বা তার চেয়ে বেশি স্থায়ী হলে।
দ্বিতীয়ত,
অ্যাফেব্রাইল ফেজ: এ সময় শিশুর জ্বর থাকে না। সাধারণত এর সময়কাল থাকে দু-তিনদিন।
তৃতীয়ত,
কনভালিসেন্ট ফেজ: যখন শিশুর শরীরে র্যাশ দেখা যায়। এর সময়কাল থাকে চার-পাঁচদিন।
কেননা এই ক্রিটিক্যাল ফেজে শিশুর জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর রোগটি
সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারে। এ সময়ে রোগীর শরীরে প্লাজমা লিকেজ হয়ে
বিভিন্ন অংশে জমা হয়ে থাকে। এ কারণে রোগীর পেট ফুলে যায় বা রক্তক্ষরণের মতো
সমস্যা দেখা দেয় এবং যার কারণে শিশুদের শক সিনড্রোম হতে পারে।
তাই জ্বর
সেরে যাওয়ার দু-তিনদিন শিশুকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন
ডা. আবু তালহা।
২. শিশুর
মধ্যে স্বাভাবিক চঞ্চলতা থাকে না। শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং ঝিমাতে থাকে। অযথা
কান্নাকাটি করে।
৩. শিশুর
মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, কিছুই
খেতে চায় না। বমি বমি ভাব হয় বা কিছু খেলেই বমি করে দেয়।
৪. ৬-৮
ঘণ্টার মধ্যে শিশুর প্রস্রাব না হওয়া ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি।
৫. শরীরে
লালচে র্যাশ দেখা দিতে পারে।
৬.
মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, পেটব্যথা হতে পারে।
৭. হতে
পারে পানিশূন্যতা এবং পাতলা পায়খানাও।
৮. চোখ লাল
হয়ে যাওয়া, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হওয়া। এটা
মূলত অ্যাফেব্রাইল স্তরে বেশি হয়ে থাকে।
৯.
পরিস্থিতি গুরুতর হলে অর্থাৎ ডেঙ্গুর কারণে শিশুর শকে যাওয়ার অবস্থা হলে তার পেট
ফুলে যেতে পারে বা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি।
শিশুদের
ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা কেমন হয়ে থাকে
মেডিকেল পরীক্ষায়
যদি শিশুর ডেঙ্গু ধরা পড়ে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ
অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ডেঙ্গু হলেই যে শিশুকে হাসপাতালে
রেখে চিকিৎসা দিতে হবে বিষয়টা এমন নয়। আর যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে
তাহলে বাড়িতে রেখে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা
সম্ভব। শিশুর মধ্যে যদি বিপদ চিহ্ন দেখা দেয়, তাহলে
চিকিৎসকরাই তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন।
শিশুদের
ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে করণীয়
শিশুদের
ডেঙ্গু রোগ হওয়া থেকে বাঁচাতে শুরুতেই এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
১. প্রথম পরামর্শ
হলো, এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে হবে। এডিস মশা
সাধারণত গৃহস্থালির পরিষ্কার স্থির পানিতে জন্মে থাকে। যেমন ফুলের টব, গাড়ির টায়ার বা ডাবের খোলে বৃষ্টির জমা পানি ইত্যাদি। তাই এডিস মশার
লার্ভা জন্ম নিতে পারে এমন স্থানগুলো চিহ্নিত করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। বাড়ির আঙিনা
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
২. শিশুদের
দিনে ও রাতে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক শিশুকে সার্বক্ষণিক মশারির
ভেতরে রাখা জরুরি। এছাড়া হাসপাতালে কোনো শিশু যদি অন্য রোগের চিকিৎসাও নিতে আসে, তাহলে তাকেও মশারির ভেতরে রাখতে হবে। কেননা ডেঙ্গু আক্রান্ত
কাউকে এডিস মশা কামড়ে পরে অন্য শিশুকে কামড়ালে তার শরীরেও ডেঙ্গুর ভাইরাস
ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৩. শিশুরা
যে সময়টায় বাইরে ছুটোছুটি বা খেলাধুলা করে, সে
সময়টায় তাদের শরীরে মসকুইটো রেপেলেন্ট অর্থাৎ মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। কয়েক ঘণ্টা অন্তর পুনরায় এই
রেপেলেন্ট প্রয়োগ করতে হবে।
৪. শিশু
যদি অনেক ছোট হয় বা তাদের শরীরে ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে তাদের হাতে মসকুইটো রেপেলেন্ট বেল্ট বা পোশাকে প্যাচ
ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. মশার
কামড় প্রতিরোধে আরেকটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হতে পারে শিশুদের ফুল হাতা ও ফুল
প্যান্ট পরিয়ে রাখা।
৬. তবে মশা
প্রতিরোধ অ্যারোসল, মশার কয়েল বা ফাস্ট কার্ড
শিশু থেকে শুরু করে সবার জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। এর পরিবর্তে মসকুইটো কিলার বাল্ব,
ইলেকট্রিক কিলার ল্যাম্প, ইলেকট্রিক কয়েল,
মসকুইটো কিলার ব্যাট, মসকুইটো রেপেলার মেশিন,
মসকুইটো কিলার ট্র্যাপ ইত্যাদির সাহায্যে নিরাপদে মশা ঠেকানো যেতে
পারে। তবে এক্ষেত্রে এ সরঞ্জামগুলো যেন শিশুর নাগালের বাইরে থাকে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন মিস্টার তালহা।
৭. যদি
শিশুর মা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে
সেই ভাইরাসের কোনো প্রভাব মায়ের বুকের দুধে পড়ে না। কাজেই আক্রান্ত অবস্থায় মা
তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: লেখক ও গবেষক