বর্ষাকালের স্বাস্থ্যঝুঁকি

বর্ষায় রোগ ও দুর্ঘটনায় বাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রকাশ: জুলাই ২৪, ২০২৩

শর্মিলা সিনড্রেলা

বাংলা দিনপঞ্জির দ্বিতীয় ঋতুর নাম বর্ষা। আষাঢ় আর শ্রাবণ মাসজুড়ে এ ঋতুর ব্যাপ্তি। বর্ষাকাল মানেই ঝরঝর বৃষ্টির দিন। গৃহবন্দি হন বা অফিসগামী, ছোট শিশু হোক কি বৃদ্ধ—এ সময়ে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে অনেকেরই। সে যেমন পরিবেশগত কারণে, তেমন প্রতিবেশগত কারণেও। 

বিশ্ব সংসারের প্রতিটি জীবের সঙ্গে পরিবেশের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। সেই আন্তঃসম্পর্ককেই বলা হয় প্রতিবেশ। ইংরেজিতে যা ইকোসিস্টেম। এ কারণেই পরিবেশ বদলালে অনেকগুলো রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বর্ষাকালে আমাদের চারপাশের পরিবেশ অনেকখানি বদলে যায়, যার ফলে প্রতিবেশের বা পুরো ইকোসিস্টেমের অনেকটা বদল আসে। এতে বেশকিছু রোগ বা দুর্ঘটনার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, তাতে তৈরি হয় স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমনকি কখনো কখনো সেগুলো প্রাণনাশীও হতে পারে। তাই সতর্কতা দরকার সবচেয়ে বেশি। তা না হলে এসব রোগ আরো বেশি তীব্র হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘‌বর্ষাকালে সাধারণত দুই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এর একটি হচ্ছে বর্ষার জন্য বৃষ্টি হতে থাকে, নদীভাঙন দেখা দেয়, বন্যা দেখা দেয় ইত্যাদি। এ ঋতুতে পেটের পীড়ায় খুব বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। শিশুদের তো এ সমস্যা হয়ই, বড়দেরও হয়। ছোট হোক বা বড়, পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার মানেই হলো, নিশ্চয়ই পানিটা ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত করা হয়নি। মানে হয়তো পানিটা ঠিকমতো পরিশোধন করে খাওয়া হচ্ছে না। পানি ঠিকঠাক জীবাণুমুক্ত করা থাকলে খোসপাঁচড়াও হবে না। পানি ঠিক না থাকলে অনেক রকমের রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এতে যেমন টাইফয়েড জ্বর, ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি হয়, তেমন চোখেরও অনেক রোগ হয়।’

পানির ব্যবহার ছাড়াও পরিবেশে স্যাঁতসেঁতে ভাব থাকার কারণে এ সময় কিছু ইনফেকশন দেখা হয়। এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‌বর্ষাকালে শিশুদের পায়ের আঙুলের ফাঁকে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়। ফাঙ্গাল ইনফেকশন থেকে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়, তাতে পুঁজ হয়ে যায়। সেটা খুব বড় হয়ে যায়। এছাড়া আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয় চারপাশে। এ সময় খুব বেশি সাপের কামড়ের ঘটনা দেখা দেয়, পানিতে ডোবা বেড়ে যায়, গাছপালা ভেঙেও অনেকে হতাহত হয়।’ 

বর্ষাকালে প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে রোগগুলো দেখা দেয় তা হলো মশাবাহিত রোগ। বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় নানা জায়গায় জমে থাকা পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাতে পরিবেশের মধ্যে মশার প্রকোপ তীব্র আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধি পায় অনেক বেশি। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার জন্য বর্ষাকালকে ভয়ংকর সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ঋতুতে মশা থেকে বাড়তি সতর্ক থাকা তাই খুবই জরুরি।

এ সময়ে সাপে কাটার ঘটনাও বেশি দেখা যায়। বৃষ্টির কারণে এ সময় পরিবেশে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাতে বেড়ে যায় সাপের উপদ্রবও। গবেষকদের মতে, বর্ষায় সাপ ডাঙ্গায় বা শুকনো জায়গায় বসবাস করে অথবা করতে চায়। এ সময় চারদিকে পানি থাকায় বিষধর সাপও শুষ্ক ও উঁচু স্থানের সন্ধানে মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ে। শুধু ঘরই নয় রাস্তা, জমির আইল, কবরস্থান, কাঠের স্তূপ, খড়ের গাদা থেকে শুরু করে অনেক স্থানেই এ সময় সাপ আসতে পারে। তবে সাপে কাটার ঘটনা সাধারণত গ্রামাঞ্চলে বা কৃষিসংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি হয়। প্রতি বছরের বর্ষায় সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে। অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিলে সেখানে এ ধরনের সংকট বেশি তৈরি হয়। বন্যার সময় সাপে কামড়ানো প্রাদুর্ভাব হিসেবে দেখা দেয়। তাই বর্ষাকালে সাপের কামড় থেকেও সতর্ক থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। আর সাপের কামড়ে অন্তত ছয় হাজার মানুষ মারা যায়। প্রতি বছর বন্যার সময় অর্থাৎ মে, জুন এবং জুলাই—এ তিন মাসে সাপের কামড়ের ঘটনা এবং এ কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে।

বর্ষায় সবচেয়ে সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ হলো সর্দি-কাশি। বর্ষাকালে তাপমাত্রা হঠাৎ করে ওঠানামা করে। তাতেই এ সংক্রমণের শিকার হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে ফ্লুতে বেশির ভাগ মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। ফলে নাক দিয়ে সর্দি পড়া, গলা ব্যথা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, জ্বর, কাশিসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

বর্ষাকালে সবকিছুতে ছত্রাকের প্রবণতা বাড়ে। এ সময় শরীরেরও অনেক জায়গায় ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দেয়। সেখান থেকে এ রোগের প্রবণতা বাড়ে।  কৃমিতে সংক্রমণের ঘটনা সারা বছরই ঘটতে থাকলেও বর্ষাকালে এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এ সময় মাটিতে থাকা কৃমির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াই এর মূল কারণ। পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় রয়েছে, যা এ রোগের সংক্রমণ বাড়াতে বেশ ভূমিকা পালন করে।

এছাড়া এটি বৃষ্টিবাদলের ঋতু হওয়ায় বজ্রপাতের মতো ঘটনাও দেখা যায়। তাই এটিও একটি সংকট হিসেবে দেখা দেয়। গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয় ৫ হাজার ৬০০ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ আড়াই হাজার জন প্রাণ হারিয়েছে ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে। বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ শতাংশই কৃষিজীবী। 

সব মিলিয়ে বর্ষাকালে বেশকিছু রোগ ও দুর্ঘটনার প্রবণতা বেশি দেখা দেয়। সেসব থেকে সতর্ক থাকতে হলে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫