শিল্পীকে চেনার সবচেয়ে ভালো উপায় শিল্পকর্ম। এমন কথা সবসময় হয়তো খাটে না। তবে বাঙ্কসির ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সত্য নেই। গেরিলার মতো রাতের আঁধারে আসেন তিনি, শহরের কোনো দেয়াল বা স্থাপনায় ইঙ্গিতপূর্ণ গ্রাফিতি এঁকে হারিয়ে যান। তাকে আর চিনবেই বা কী দিয়ে! বাঙ্কসির কাছে দেয়াল অনেক বড় অস্ত্র। যার গায়ে রঙ ছিটিয়ে মানুষকে আঘাত করতে চান।
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর গ্যালারি অব মডার্ন আর্টে শুরু হয়েছে এই রহস্যমানবের একক প্রদর্শনী। শুরুর মাত্র একদিন আগে অর্থাৎ ১৭ জুন ঘোষিত হয় ‘কাট অ্যান্ড রান: ২৫ ইয়ার্স কার্ড লেবার’। আর যথারীতি ঘোষণা দিয়েই লাপাত্তা বাঙ্কসি।
১৪ বছরের মধ্যে এটিই বাঙ্কসির প্রথম প্রদর্শনী। এখানে তার সিকি শতাব্দীর সফর উঠে এসেছে। স্টেনসিল মাধ্যমে আঁকা বিখ্যাত কিছু কাজের নতুন সংস্করণ তৈরি করেছেন। ‘কিসিং কপার’-এর কথা মনে আছে তো! থাকছে ‘মোবাইল লাভার্স’ও। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলের দেয়ালে আঁকা ওই গ্রাফিতিতে হাল জমানার সম্পর্ক উঠে এসেছে। এক যুগল পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেও তাদের চোখ সেলফোন স্ক্রিনে।
সর্বশেষ কোনো প্রদর্শনীতে বাঙ্কসি অংশ নেন ২০১৫ সালে। সামারসেট রিসোর্টের ওই অস্থায়ী আর্ট প্রজেক্টে অংশ নেন সমকালীন অর্ধশতাধিক শিল্পী। একক শো ছিল ২০০৯ সালের ‘বাঙ্কসি ভার্সেস ব্রিস্টল মিউজিয়াম’।
বাঙ্কসি হলেন সেই শিল্পী, যার নাম বা পরিচয় তো দূরের কথা; ২০০৩ সালের পর সাক্ষাৎকারও দেননি। বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তিকে বাঙ্কসি হিসেবে ভাবা হলেও তা অনুমানেই থেকে গেছে। তবে অনেকটাই নিশ্চিত বাঙ্কসির বয়স এখন ৫০-এর আশপাশে, থাকেন ব্রিস্টলে। অদৃশ্য থাকার পক্ষে তার যুক্তি, আমি জানি না মানুষ কেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন বিশদ জনসমক্ষে আনতে এত আগ্রহী। তারা ভুলে যান নজরের বাইরে থাকাটাই সুপারপাওয়ার।
বাঙ্কসি নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছেন, গ্রাফিতিগুলো কীভাবে এঁকেছেন তার সব মিলিয়েই ‘কাট অ্যান্ড রান’ প্রদর্শনী। তিনি মজা করে জানান, স্টেনসিলগুলো বছরের পর বছর লুকিয়ে রেখেছিলেন। কারণ এর মাধ্যমে অন্যের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। এখন অভিযোগের সময় পার হয়ে গেছে। তবে বাঙ্কসি ‘নিশ্চিত নন’ গ্রাফিতি আঁকা কতটা বড় অপরাধ।
‘অপরাধ’ শব্দটি যখন এল, তার সঙ্গে গ্রাফিতিকে মিলিয়ে পড়া যাক। স্ট্রিট আর্ট বেশির ভাগ সময় ব্রাত্য হলেও সমকালীন বেদনা-শোষণের প্রামাণ্য দলিল। একপক্ষের কাছে শোষিতের ভাষা। আর শোষকদের কাছে হয়ে উঠতে পারে অপরাধ। বাঙ্কসির এ ‘অপরাধ’ শুধু ব্রিস্টল বা যুক্তরাজ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেখা গেছে ইসরায়েল ও সাম্প্রতিক যুদ্ধক্লিষ্ট ইউক্রেনে।
বাঙ্কসির আঁকা ‘গার্ল উইথ বেলুন’ ভোটাভুটিতে ব্রিটেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পকর্ম বিবেচিত হয়েছিল। ২০১৮ সালে লন্ডনে ১০ লাখ ডলারে নিলামে তোলা হয়েছিল ছবিটি। তখন দর্শকের চোখের সামনে ফ্রেম খুলে আধাআধি নিচে নেমে আসে ও কিছু অংশ কাটা পড়ে। পরে এটি আলাদা শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। বাঙ্কসি শিরোনাম দেন ‘লাভ ইজ ইন দ্য বিন’। তিন বছর পর ওই ছবি ২০ গুণ দামে বিক্রি করেন ক্রেতা। সেই ঘটনার বিস্তারিত থাকছে প্রদর্শনীতে। থাকছে ইসরায়েলের বেথলেহেমে আঁকা দুটি গ্রাফিতি। যার একটিতে দেখা যায়, ইসরায়েলি সৈন্য ও ফিলিস্তিনি নাগরিক বালিশ ছুড়ে যুদ্ধ করছে।
সমকালীন মনস্তত্ত্ব ও বিশ্ব ব্যবস্থাকে বুঝতে বাঙ্কসির গ্রাফিতি গুরুত্বপূর্ণ। নেই নৃংশসতা বা রক্তারক্তি। তিনি মুছে দেন শিল্পের দুর্বোধ্যতা ও সাধারণ মানুষের দূরত্ব। এমন ভাব-ভাষায় কথা বলেন যা কারো বুঝতে অসুবিধে হয় না। ধূমকেতুর মতো হাজির হওয়া বাঙ্কসি এ প্রদর্শনীতে নিজেকে পুরোটাই উন্মুক্ত করেছেন। ঠিক এ কারণে, ‘কাট অ্যান্ড রান’ স্রেফ আরেকটি প্রদর্শনী নয়, গ্রাফিতির ইশতেহার।