মুখগহ্বরের ক্যান্সার

মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা

প্রকাশ: জুন ১৯, ২০২৩

অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার

মুখগহ্বরের ক্যান্সার কী? 

শরীরের অন্যান্য জায়গার মতো মুখগহ্বরেও ক্যান্সার হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের কারণে এ রোগ সৃষ্টি হয়। কোষের অভ্যন্তরের ডিএনএর অস্বাভাবিক বিবর্তন থেকে শুরু হয় এ পরিবর্তন। ম্যালিগন্যান্ট বা ক্যান্সার সেল মুখের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে মাথা, ঘাড় কিংবা শরীরের অন্য অংশে। অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়াকে বলা হয় মেটাস্টেসিস। আবার আশপাশের লসিকাগ্রন্থিতেও ছড়াতে পারে ক্যান্সার। ঠোঁট, জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, তালু, গালের ভেতরের দিক, চোয়াল, লালাগ্রন্থিসহ মুখের ভেতরের যেকোনো স্থানে ক্যান্সার হতে পারে।

বিস্তার

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার প্রকাশিত গ্লোবোক্যান ২০২০ অনুসারে, বাংলাদেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতি বছর প্রায় চৌদ্দ হাজার মানুষ নতুন করে মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং আট হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ ক্যান্সারে আক্রান্তের হার নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ (দ্বিতীয় শীর্ষ), পুরুষদের মধ্যে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ (তৃতীয় স্থান) এবং নারীদের মধ্যে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ (পঞ্চম স্থান)।

ঝুঁকি বা রিস্ক ফ্যাক্টর

তামাক, তাতে সেটা ধূমপান কিংবা ধোঁয়াবিহীন হোক, মুখগহ্বরের ক্যান্সারের জন্য প্রধানত দায়ী। বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা, জর্দা, সাদাপাতা, গুল, খৈনি, পানবাহার—এসবই ক্ষতিকারক, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। মদ্যপান, মুখের অপরিচ্ছন্নতাও এ ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। ধারালো দাঁতের সঙ্গে ক্রমাগত ঘর্ষণ থেকেও শুরু হতে পারে মুখে ঘা হওয়ার প্রবণতা। তাছাড়া অতিরিক্ত রোদে দীর্ঘ সময় থাকলে অতি বেগুনি রশ্মি ঠোঁটের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ, এইচআইভি সংক্রমণ কিংবা অন্য কোনো কারণে শরীরের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেও মুখের ভেতরে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে।

লক্ষণ

মুখগহ্বরের ভেতরে কোথাও সহজে সারছে না এমন ক্ষত বা ঘা দেখা দিলেই সতর্ক হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ রোগে আক্রান্ত হলে মুখের কোথাও ফুলে যাওয়া বা পিণ্ড বা চাকার মতো দেখা দিতে পারে। মুখের ভেতরের পিচ্ছিল ঝিল্লির কোথাও লাল, সাদা কিংবা লাল-সাদা দাগ, ঝিল্লির নিচ থেকে শুরু হওয়া ঘা কিংবা শক্ত হয়ে যাওয়া—এ ধরনের পরিবর্তন মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। মুখে, কানে কিংবা ঢোক গিলতে ব্যথা হতে পারে। 

প্রতিরোধ 

ঝুঁকি কমানোর জন্য ধূমপানসহ সব ধরনের তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার বর্জন করতে হবে। মদ খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। অতিরিক্ত রোদ এড়াতে হবে। আর নিয়মিত দাঁতের যত্ন ও দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

স্ক্রিনিং বা লক্ষণপূর্ব পর্যায়ে নির্ণয়

পুরোপুরি প্রকাশ পাওয়ার আগেই মুখগহ্বরের ক্যান্সার কিংবা ক্যান্সার-পূর্ব অবস্থা নির্ণয় করার জন্য চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করানোকে স্ক্রিনিং বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো প্রাথমিক পর্যায়েই ক্যান্সার নির্ণয় করা। এতে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আলোর উৎসের কাছে নিয়ে মুখ পুরোপুরি হাঁ করা অবস্থায় পরীক্ষা করে দেখা হয় মুখগহ্বরের কোথাও ওপরে উল্লেখিত তিন ধরনের অস্বাভাবিকতা (লাল, সাদা দাগ, ঝিল্লির নিচে ঘা কিংবা শক্ত হয়ে যাওয়া) আছে কিনা? থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা নিকটস্থ হাসপাতালে পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। 

তবে এ রোগে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা। যেকোনো সমস্যা পাওয়া গেলেই তা ক্যান্সার না-ও হতে পারে। বাংলাদেশে জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি নেই। বিএসএমএমইউ থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যান্সারের অসংগঠিত কর্মসূচি থাকলেও মুখগহ্বরের ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি নেই, এটা খুবই দুঃখজনক। সম্প্রতি ঢাকার লালমাটিয়ায় কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টারে মুখগহ্বরের ক্যান্সারের প্রাথমিক স্ক্রিনিং চালু হয়েছে। 

চিকিৎসা

যদি এ রোগ অনেক বেশি ছড়িয়ে না থাকে তাহলে সার্জারি বা অপারেশন করা হয়। পরে রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ কিংবা কেমোথেরাপি বা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় অপারেশনের মাধ্যমে মুখ ও চোয়ালের রিকনস্ট্রাকশন বা পুনর্গঠন করার প্রয়োজন হয়। চিকিৎসা শুরুর আগেই সমন্বিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পুরো চিকিৎসার পরিকল্পনা করে নিতে হয়। প্রথম পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হলে এ রোগ পুরোপুরি নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে। 

চাই সচেতনতা

প্রতিরোধের জন্য, প্রথম অবস্থায় নির্ণয়ের জন্য, সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করা খুব জরুরি। এর জন্য চাই কার্যকর কর্মসূচি। পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণও খুব জরুরি। 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক

ক্যান্সার রোগতত্ত্ব, প্রতিরোধ ও গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫