কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বাংলাদেশের আইনপ্রণেতারা কী ভাবছেন?

প্রকাশ: জুন ১৬, ২০২৩

জামান মঞ্জু

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত বিকাশের কারণে আজ সারা বিশ্বের সমাজ ও অর্থনীতির সর্বস্তরে অভূতপূর্ব অরাজকতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, চ্যাটজিপিটি কিংবা গুগল বার্ডের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক বৃহৎ ভাষিক মডেল (large language model) প্রোগ্রামগুলোকে প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত টেক্সট কিংবা ডাটার কপিরাইট ভায়োলেশন নিয়েও। সব দেশের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের এখন তাই অন্যতম গুরুদায়িত্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসৃষ্ট অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে একক কিংবা যৌথভাবে আইন, বিধিমালা ও প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনসভা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে এরই মধ্যে আইনপ্রণয়নের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ইতালির ডাটা সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ সে দেশে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জর্নাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কোনো টেক কোম্পানি যথাযথ লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতীত ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তাদের সংবাদকর্মীদের পরিশ্রম ও মেধাসৃষ্ট কোনো টেক্সট কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রোগ্রামকে প্রশিক্ষণে ব্যবহার করতে পারবে না।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভূতপূর্ব বিকাশে শঙ্কিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেট একটি প্যানেল গঠন করে চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অ্যাল্টম্যানকে কংগ্রেশনাল শুনানিতে হাজিরা দিতে ডেকেছিল। গত ১৬ মে এ শুনানিতে স্যাম অ্যাল্টম্যান নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীন নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

কিন্তু বাংলাদেশের আইনপ্রণেতারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশন নিয়ে আদৌ ভাবিত বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের সংসদে এখন পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা শোনা যায়নি, যদিওবা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর পার্লামেন্টে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে।

চ্যাটজিপিটি কিংবা গুগল বার্ডের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রোগ্রামগুলোকে প্রশিক্ষণার্থে বাংলা নিউজ আউটলেটগুলোর তথা অন্যান্য বাংলা ওয়েবসাইটের টেক্সট বিনা অনুমতিতে নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই মার্কিন টিভি চ্যানেল সিবিএসের ‘সিক্সটি মিনিটস’ টক শোতে গর্বের সঙ্গে বলেছেন যে গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবট গুগল বার্ড নিজে নিজেই বাংলা শিখেছে। কিন্তু সে বাংলা শিখল কোত্থেকে? সে বাংলা শিখেছে ইন্টারনেটে বিদ্যমান বাংলা টেক্সটগুলোর আলোকে। গুগল বার্ড, চ্যাটজিপিটি কিংবা বিং চ্যাট যখন বাংলা ভাষায় কিংবা যেকোনো ভাষায় কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় বা কোনো টেক্সট জেনারেট করে—তারা কিন্তু সে উত্তর বা টেক্সট জেনারেট করে তাদের প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত কিংবা ইন্টারনেট থেকে অভিলব্ধ টেক্সটগুলোর আলোকেই। এসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রোগ্রামগুলোর ট্রেনিং ডাটায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে বণিক বার্তা থেকে অন্য যেকোনো বাংলা ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত খবর বা অন্য যেকোনো ধরনের টেক্সট।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটি-৩-এর প্রশিক্ষণে যে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার কোটি টোকেন ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ৪৩০ বিলিয়ন টোকেন ইন্টারনেট থেকে লব্ধ টেক্সট থেকে প্রাপ্ত আর বাকিগুলো বিভিন্ন বই থেকে প্রাপ্ত। জিপিটি-৪-এর প্রশিক্ষণে এর চেয়ে বহু গুণ বেশি টোকেন ব্যবহার করা হয়েছে। মূল বিবেচ্য বিষয়টি হলো, একটি বই থেকে প্রাপ্ত টেক্সটের আলোকে বইটির বিষয়ের ওপর এই প্রোগ্রামগুলো তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যবহারকারীদের জন্য প্রত্যুত্তরে নতুন নতুন টেক্সট পুনঃপুন জেনারেট করছে। ফলে মূল বইয়ের লেখক কপিরাইট রেভিনিউ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সব দেশকেই তাই কপিরাইটের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে, যাতে যথাযথ লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতীত কোনো টেক কোম্পানি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কোনো প্রোগ্রামকে প্রশিক্ষণে কোনো বইয়ের টেক্সট বা সংবাদ পোর্টালের খবর ব্যবহার করতে না পারে।

ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা বিভিন্ন লিংকের প্রিভিউ প্রদর্শন নিয়েও একসময় তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। কারণ প্রিভিউ দেখে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা আর মূল লিংকে প্রবেশের প্রয়োজন মনে করে না। ফলে সংবাদ পোর্টালগুলোর রেভিনিউ কমে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ দ্য হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ‘দ্য নিউজ মিডিয়া বার্গেইনিং কোড’ নামে আইন প্রণয়ন করে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের রেভিনিউ বাঁচাতে। ওই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অস্ট্রেলীয় কোনো সংবাদ পোর্টালে প্রকাশিত খবরের লিংক শেয়ার হলে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে তার জন্য কপিরাইট মূল্য সংবাদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে দিতে বাধ্য করা।

এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবটগুলো আগমনের ফলে খালি চোখে দৃষ্টিগোচর হয় না এমন কপিরাইট ভায়োলেশনের মতো সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ ব্যবহারকারীরা চ্যাটবটের কাছেই যখন কোনো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাচ্ছে তখন তারা উত্তরের সোর্স সংবাদ পোর্টালে আর ঢুকছে না। মাইক্রোসফটের বিং চ্যাট, ব্রেভ সার্চ ইঞ্জিনের ব্রেভ সামারি কিংবা গুগল বার্ডকে চলতি ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা বিভিন্ন সংবাদ পোর্টাল ঘেঁটে একটা সারাংশ উত্তর তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে ইন্টারনেট ট্রাফিকের সুষম বণ্টন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, যা অতীব উদ্বেগের বিষয়।

তাই আইন প্রণয়ন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলোর কিংবা চ্যাটবটগুলোর লাগামছাড়া কপিরাইট ভায়োলেশন ঠেকাতে না পারলে একদিকে বিগ টেক কোম্পানিগুলো অতি ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে, আর অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমগুলো রেভিনিউ হারাবে। ফলে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা হ্রাস পাচ্ছে এবং আরো পাবে। এ রকম চলতে থাকলে সংবাদকর্মীরা অভিনিবেশ দাবি করে এমন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে নিরুৎসাহী বোধ করবেন। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সংসদীয় কমিটি গঠন করে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তথা বহির্বিশ্বের আইনসভাগুলোর তৎপরতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আইন প্রণয়ন করতে হবে। যাতে করে দেশীয় সংবাদ পোর্টাল তথা অন্য বিভিন্ন বিষয়সংশ্লিষ্ট পোর্টালের রেভিনিউ রক্ষা পায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই কপিরাইট ভায়োলেশন থেকে বাংলাদেশের ওয়েবসাইটগুলোকে রক্ষা করতে সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে বাংলাদেশ সরকার সংসদপ্রণীত আইন তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো অঙ্গসংস্থার কোনো বিধি বা প্রবিধান তৈরি করেনি। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে একটি স্ট্র্যাটেজি পেপার প্রকাশ করেছিল, যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শুধু ইতিবাচক দিকটাই তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি অতি জনবহুল ও অতি বেকারত্বের বোঝা বহনকারী দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেকারত্বের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেবে। সেই সঙ্গে শ্রেণী বিভাজনের প্রকোপ প্রকট আকার ধারণ করবে। কারণ সাধারণ মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকটার কুফল ভোগ করবে। তাই সময় থাকতেই আইনপ্রণেতাদের জনগণের স্বার্থে তথা দেশীয় সংবাদমাধ্যম ও শিল্পমাধ্যমের স্বার্থে এখনই আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন করে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কপিরাইট হিস্যা রক্ষা করতে হবে।

জামান মঞ্জু: সাংবাদিক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫