মোয়াজ্জেম হোসেন জনি। চারুকলার
পড়াশোনা শেষে শিল্পশিক্ষা নিয়েছেন কলকাতার রবীন্দ্রভারতী ও চীনের হ্যাংচৌ শহরের একাডেমি অব ফাইন আর্টসে। তাই তার
ছাপচিত্রের ক্যানভাসে নানা সময়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশ, কলকাতা
ও চীনের জীবন। বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড, চারুকলার শিল্পাচার্য
জয়নুল আবেদিন স্বর্ণপদক রয়েছে এ শিল্পীর ঝুলিতে।
শৈশব শিল্প
পরিবারের কেউ কোনো কিছু করলে তা মনের মধ্যে গেঁথে যায়, ভালো লাগা তৈরি হয়। আমার মামা শিল্পী ম. শফিক। তিনি আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। যখন ছোট ছিলাম, তিনি ছবি আঁকতেন, দেখতাম। ফলে এর প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে শিল্পের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযোগ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে।
চিত্রকর্ম ‘ফিয়ার টু ফ্রিডম’। ছবি :
স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যম
শিল্পীকে বেঁচে থাকতে হলে এক মাধ্যমে কাজ করলে
চলবে না এবং তাকে এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে এক্সপেরিমেন্ট করার
চেষ্টা করেছি আমি। যখন যে মাধ্যমে কাজ করেছি,
তা খুব ভালোভাবে শিখতে চেয়েছি। যেটাই শুরু করেছি, শেষ না দেখে ছাড়িনি। তাই অনেক মাধ্যমই ভালো লাগে। আমার শিল্পচর্চায়
পরিবর্তন এসেছে প্রতি ধাপে, তবে জোর করে কোনো পরিবর্তন আনতে
চাইনি আমি। জোর করে নিজেকে বদলাতে চাইনি। চেষ্টা করেছি যেন নিজেকে বুঝতে পারি,
নিজেকে জানতে পারি। তার পরও বলা যায়, আমার
পেইন্টিংয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি। পেইন্টিং বলতে ব্রাশিং বা পেন্সিল। চারুকলায় ভর্তি
হওয়ার পরে ক্লাসের বাইরেও আমি অনেক স্কেচ ও ড্রয়িং করেছি। লাইন দিতে আমার খুব ভালো
লাগে। এখন অ্যাক্রিলিকে কাজ করতেও খুব ভালো লাগছে। বর্তমানে
কাঠ খোদাই আর এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট নিয়ে কাজ করছি।
প্রিয় শিল্পী ও কাজ
রফিকুন নবী স্যারের যে ফিগারের বিউটিফিকেশন ও কন্ট্রিবিউশন, পড়াশোনার সময় থেকেই তা অদ্ভুত রকম ভালো লাগত। কাঠ খোদাই শিল্পী আনিসুজ্জামানের কাজও ভীষণ ভালো লাগার জায়গা। রবীন্দ্রভারতীর প্রফেসর জয়ন্ত নস্করের এচিংয়ের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হই। তার জন্যই মূলত আমি রবীন্দ্রভারতীতে পড়তে যাই। তাছাড়া অনুপম সাদের কাজও আমার অনেক ভালো লাগে। পিকাসোর ড্রয়িংয়ের পোর্ট্রেট আমি আগে থেকেই অনুসরণ করি। দেখা যায়, তিনি একটা ছবি এঁকেছেন, সেখানে রঙ দিতে দিতে একটা ভিন্ন জায়গায় চলে যায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক কৃষ্ণা রেড্ডির প্রদর্শনী দেখেও মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। মনে পড়ে, তার একটা এক্সিবিশন পাঁচবার রাউন্ড দিয়ে দেখেছিলাম। হরেন দাস ও শফিউদ্দিনের রিয়ালিস্টিক মাধ্যমে যে কাজগুলো সেগুলোও অসাধারণ। কিবরিয়া স্যার যে কালার ও অনুভূতি চোখের সামনে দাঁড় করান, তা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ছবি:
কাজ-প্রদর্শনী-পুরস্কার
যে সময় আমাকে অনুভব করেছে বা আমি যে সময়টাকে
অনুভব করতে পেরেছি সেটাই এঁকেছি। আমি যখন ঢাকায় থেকেছি ঢাকার মতো কাজ করেছি, যখন কলকাতায় গেছি তখন কলকাতার
মানুষের সঙ্গে মিশেছি, তাদের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেছি। এ
কারণেই শিল্প আমাকে এতখানি স্পর্শ করতে পেরেছে। প্রথম যে অ্যাওয়ার্ড পাই সেটা
বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড। চারুকলা থেকে প্রতি বছরের ১৫ আগস্ট এটি দেয়া হয়। সে সময়ে
বার্জারের এক্সিবিশনে অংশ নিয়ে সেকেন্ড অ্যাওয়ার্ড পাই। এরপরে আরো অনেক অ্যাওয়ার্ড
পেলেও এ দুটি খুবই স্মরণীয়। চারুকলা থেকে প্রতি বছর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
স্বর্ণপদক দেয়া হয়, ২০১২ সালে সেটা পাই। নবীন শিল্পী
সম্মাননা পদক পেয়েছি আমি। রাজশাহীতেও বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড পাই।
আর্ট ক্যাম্প-রেসিডেন্সি
অফিশিয়ালি তেমন রেসিডেন্সি করা না হলেও আনঅফিশিয়ালি জয়ন্ত নস্কর আমাকে তার স্টুডিওতে থেকে কাজ শেখার সুযোগ দিয়েছেন। ভারতে কয়েকটা আর্ট ক্যাম্প করেছি। শিল্পকলায় কভিডের সময়ে একটা বা দুইটা আর্ট ক্যাম্প করেছি। আমার লক্ষ্যই ছবি আঁকা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিল্পচর্চার সঙ্গে থাকতে চাই। এ চর্চায় থাকলে আমি নিজে নিজের কাছে ধনী থাকব।
গ্রন্থনা: শর্মিলা সিনড্রেলা