চলচ্চিত্র অধ্যয়ন

পড়তে পড়তে সিনেমা

প্রকাশ: জুন ১২, ২০২৩

ভাবুন তো পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্রগুলো দেখা আর বিশ্লেষণ করাই আপনার পাঠ্যসূচির মূল বিষয়। ক্লাসে বসে দেখছেন অ্যাং লির সিনেমা ‘লাইফ অব পাই’, ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’ বা আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রশোমন’। আবার ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পের বিষয়ও সিনেমা। কোনো দিন হয়তো শিক্ষকের সঙ্গে দল বেঁধে গেলেন খন্দকার সুমনের ‘সাঁতাও’ দেখতে। আবার পরদিনই এফডিসিতে শাকিব খান অভিনীত ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার শুটিং দেখতে। হয়তো কখনো গেলেন ফিল্ম আর্কাইভের হিমঘরে সোনালি যুগের অনুভূতি নিতে। আবার হয়তো নিজেই নেমে পড়লেন শুটিংয়ে। কেমন হয় যদি পড়ার বিষয় আর প্রেমের বিষয় দুটিই হয় সিনেমা। সত্যিই তাই, বাংলাদেশে বসে এখন সিনেমা দেখতে দেখতে আপনিও হয়ে যেতে পারেন গ্র্যাজুয়েট।              

গণযোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের শক্তিকে প্রথম চিনেছিল রাশানরা। ১৯১৯ সালে তারা বিশ্বের প্রথম ফিল্ম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল ‘অল-ইউনিয়ন স্টেট ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফি’। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি মস্কো ফিল্ম স্কুল নামে পরিচিত। ভূরাজনৈতিক কারণে ঢাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি শুরু হয়েছে চলচ্চিত্রের সূচনার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর। চলচ্চিত্র নির্মাণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে লেগেছে আরো ছয় দশক। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১৩ সালে সরকার বাংলাদেশ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (বিসিটিআই) শুরু করে। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এর আগেই চলচ্চিত্র নির্মাণে উচ্চতর ডিগ্রি দেয়া শুরু করেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরেই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার শুরু। গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ফিল্ম নিয়ে প্রথম স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৩ সালে ফিল্ম, টেলিভিশন এবং ডিজিটাল মিডিয়া বিভাগ শুরু করে। যদিও ২০১১ সালে বিভাগটি নাম পরিবর্তন করে সাংবাদিকতা এবং মিডিয়া কমিউনিকেশন হয় আর ২০১৯ সালে এসে তারা চলচ্চিত্র শিক্ষা কার্যক্রম থেকে পুরোপুরি সরে আসে। ২০০৪ সালে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) চলচ্চিত্র শিক্ষা চালু করে। এ অঞ্চলের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১২ সালে এসে টেলিভিশন, ফিল্ম এবং ফটোগ্রাফি বিভাগ শুরু করে। 

অন্যদের মাঝে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে। বর্তমানে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র তিনটি সরকারি এবং চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করে। এর মাঝে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সুযোগ আছে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধীনে স্নাতক স্তরে ডিজিটাল ফিল্ম এবং টেলিভিশন প্রোডাকশনে মেজর করা যায়। এর বাইরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগ রয়েছে, যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে কয়েকটি কোর্স করায়। পাশাপাশি, বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (বিসিটিআই) এবং পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা দিচ্ছে।

দীর্ঘ সময় প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার সুযোগের অভাবে নুয়ে পড়তে থাকা ঢাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ঘুড়ে দাঁড়াচ্ছে মূলত তরুণ নির্মাতাদের হাত ধরে, যারা কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার সংস্পর্শে এসেছে। চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার গুরুত্ব বুঝেছিলেন বহু আগেই। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রসার। যার ফল আমরা পেতে শুরু করেছি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিসিক্ত হয়ে। কান, বার্লিন, বুসান, কোথায় নেই এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। এমনকি একাধিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নিয়মিত আসর বসছে ঢাকায়। চলচ্চিত্র নির্মাণে তাত্ত্বিক ও শৈল্পিক জ্ঞানের পাশাপাশি কারিগরি জ্ঞানেরও প্রয়োজন। এ সবকিছুর সমন্বয় ঘটাচ্ছে চলচ্চিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। নির্মাতা ছাড়াও অভিনয় শিল্পী, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, শিল্প নির্দেশক, প্রযোজকসহ চলচ্চিত্রের প্রায় সব শাখায় ছড়িয়ে পড়ছে এ শিক্ষার্থীরা। এমনকি টেলিভিশন, ওটিটির মতো বিকল্প মাধ্যমগুলোও এখন এ শিক্ষার্থীদের দখলে। ইউল্যাবের সাবেক শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী এখন টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সংগঠক। 

অন্যদিকে স্ট্যামফোর্ডের মাজহারুল ইসলাম রাজু চিত্রগ্রহণে (লাল মোরগের ঝুঁটি) এবং ইউল্যাবের ইদিলা কাছরিন ফরিদ পোশাক ও সাজসজ্জায় (নোনাজলের কাব্য) চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার ২০২১-এ ভূষিত হয়েছেন। নির্মাতা হিসাবে দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছেন এলিজাবেথ ডি কস্তা (বাংলা সার্ফ গার্লস), জাহিদ গগন (প্রেম পুরাণ), রাওয়ান সায়মা (ডিকোডিং জেন্ডার), ফুয়াদুজ্জামান ফুয়াদ (শব্দের ভেতর ঘর), জিয়াউল হক রাজু (বাতিক বাবু)সহ আরো অনেকে। আলোচিত নেটফ্লিক্সের সিনেমা ‘এক্সট্র্যাকশন’, কানে মনোনীত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, বাণিজ্যিক সফল ‘হাওয়া’ বা ওটিটি মাতানো ‘কারাগার’ প্রতিটি টিমে কাজ করেছেন এসব প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এভাবেই চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীরা নিয়মিত নিজেদের স্বপ্নের গাছে ফুল ফোটাচ্ছেন।

শিল্পের সব মাধ্যমের সমন্বয় ঘটে চলচ্চিত্রে। সংগীত থেকে চিত্রকলা বা গল্প বলা থেকে বিনোদন-বাণিজ্য, সব বিষয়ে যদি আগ্রহ থাকে তবে চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পারে আপনার মাধ্যম। চলচ্চিত্রের উচ্চশিক্ষায় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভাবাদর্শ অনুযায়ী পাঠ্যক্রম সাজায়। কেউ ব্যবহারিক দিকে গুরুত্ব দেয়, কেউ গুরুত্ব দেয় তাত্ত্বিক আলোচনায়। দুটাই গুরুত্বপূর্ণ, নির্ভর করবে আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান। নির্মাণ দলে থাকতে হলে ব্যবহারিকে গুরুত্ব দিতে হবে, আর সমালোচক বা গবেষক হতে হলে তাত্ত্বিক বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দিন শেষে মনে রাখতে হবে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনায় আপনার ফলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে আপনার কাজের মান বা চিন্তার বৈচিত্র্য। 

মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন: সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫