পাইকারি বাজারে কেজিতে কমেছে ২৫ টাকা

২ দিনে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি

প্রকাশ: জুন ০৭, ২০২৩

শাহাদাত বিপ্লব

কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রাখা হয় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি। উৎপাদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুদ থাকার কথা থাকলেও গত এপ্রিলের মাঝামাঝিই বাড়তে শুরু করে দাম। দেড় মাসের ব্যবধানে দাম বেড়ে যায় প্রায় তিন গুণ। এ কারণে গত সোমবার থেকে ফের ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। গত দুদিনে মন্ত্রণালয় থেকে আমদানির অনুমতি পাওয়া পেঁয়াজের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৩ হাজার টন। এর প্রভাবে এরই মধ্যে খুচরা ও পাইকারি বাজারে কমতে শুরু করেছে দাম। ব্যবসায়ীরা জানান, মাত্র দুদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দাম কমেছে ২২-২৫ টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত সোম ও মঙ্গলবার ১ হাজার ২৮৮ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। সোমবার ২ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। গতকাল পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার টন। দেশীয় উৎপাদনকে সুরক্ষা দিতে গত ১৬ মার্চ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। 

রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৯০ টাকায়। যদিও দেড় মাস আগে এ দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা। বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ৩০-৪০ টাকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়। এরপর ২৪ এপ্রিল দাম বেড়ে কেজিপ্রতি বিক্রি হয় ৪০-৪৫ টাকায়। ৬ মে দাম দাঁড়ায় ৫০-৫৫ টাকায়। এরপর ৩ জুন ৭৫-৮০ এবং এর পরদিনই অর্থাৎ ৪ জুন দাম গিয়ে ঠেকে ৯০-১০০ টাকায়। 

বাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় ওইদিন কৃষি মন্ত্রণালয় ৫ জুন থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতির ঘোষণা দেয়। এর পরই নামতে শুরু করে দাম। রাজধানীর পাইকারি বাজারে বর্তমানে দেশী পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৭০-৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৬৮ টাকায়। সে হিসেবে দুদিনের ব্যবধানে দেশী পেঁয়াজের দাম পাইকারিতে কমেছে প্রায় ২২ টাকা। তবে এর প্রভাব এখনো খুচরা বাজারে পড়েনি বলে জানিয়েছে ক্রেতাসাধারণ। 

কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. বাবুল মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম কমছে। দুদিনের ব্যবধানে কেজিতে ২০-২২ টাকা কমেছে। ভারতের পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। দেশী পেঁয়াজের দাম সামনে আরো কমবে।’  

ভারত থেকে গত দুদিনে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। গতকাল ৪২টি ট্রাকে ৮৮৯ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। আগের দিন তিন ট্রাকে আসে ৬৩ টন। বর্তমানে হিলির পাইকারি বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩২-৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৫ টাকায়। এসব পেঁয়াজ ভারতের স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করার কারণে দাম এখনো কিছুটা বেশি বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। তবে এরই মধ্যে ভারতীয় পেঁয়াজের মোকাম নাসিক ও ইন্দোর অঞ্চলে পেঁয়াজ লোডিং শুরু হয়েছে। এগুলো দু-একদিনের মধ্যে বন্দরে প্রবেশ করলে দাম আরো কমে আসবে বলে জানান আমদানিকারকরা। 

হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৫ জুন থেকে আমরা পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র (আইপি) পেয়েছি। সে মোতাবেক আমদানির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজের এলসি খোলা হয়েছে। সোমবার বন্দর দিয়ে তিন ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হয়। এ কারণে দেশী পেঁয়াজের দাম কেজিতে কমেছে ২০-৩০ টাকা। আজকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজের ট্রাক দেশে ঢুকলে বাজারদরের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বাজারে দামের যে ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল তা অর্ধেকে নেমে আসবে।’

তিনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদ সামনে রেখে আমরা আমদানিকারকরা ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজের এলসি খোলাসহ আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হবে। এতে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম যাতে ঠিকঠাক থাকে সেটিই খেয়াল রাখা হচ্ছে।’ 

এদিকে হিলির খুচরা বাজারে দেশী পেঁয়াজের দাম দুদিনের ব্যবধানে প্রায় ২৫ টাকা কমেছে। গতকাল সরজমিনে সেখানকার বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকায়। গত সোমবার তা ৭৫ টাকা ছিল এবং আগের দিন বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। 

হিলি বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা হায়দার আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারত থেকে আমদানি শুরু হওয়ায় বাজারে পেঁয়াজের দাম কমছে। যে পেঁয়াজ রোববার ৯০ টাকা কিনেছি, সেটি আজ ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। দাম কমায় আমাদের মতো মানুষের সুবিধা হয়েছে।’

আসলাম হোসেন নামে আরেকজন ক্রেতা বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম যদি ৩০-৪০ টাকার মধ্যে আসে, তাহলে আমাদের জন্য খুব ভালো হয়। সামনে কোরবানির ঈদ, এ সময় পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা থাকে। এ কারণে দামটা কমলে খুব ভালো হয়।’

হিলি বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজ দেশে প্রবেশ করছে, এ আতঙ্কেই আড়তদাররা দাম কমিয়ে দিয়েছে। মোকামে যে দেশী পেঁয়াজ ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ ছিল, সেটি ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় নেমে এসেছে। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কম, সেজন্য দেশী পেঁয়াজের চাহিদা কমার পাশাপাশি দামও কমে যাবে। লোকসান গুনতে হবে, যে কারণে আড়তদাররা কম দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে আমরাও কম দামে কিনতে পারছি। আর এর প্রভাবে কম দামে বিক্রি করছি। ভারতীয় পেঁয়াজ ঢোকার খবরে দেশী পেঁয়াজের বেচাকেনা নেই বললেই চলে। সবাই যখন শুনেছে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে, আমদানি হচ্ছে, সে কারণে ক্রেতার সংখ্যাও কমে গেছে। তারা জানে ভারতীয় পেঁয়াজ ঢুকলে ৪০-৪৫ টাকায় কেনা যাবে। তাই বাড়তি দামে কেউ দেশী পেঁয়াজ কিনছে না।’  

হিলি স্থলবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি না থাকায় গত ১৬ মার্চ থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ছিল। আমদানির অনুমতি পাওয়ায় গত সোমবার আবারো এ বন্দর দিয়ে আমদানি শুরু হয়। পেঁয়াজ যেহেতু কাঁচামাল, দ্রুত পচনশীল পণ্য তাই কাস্টমসের প্রক্রিয়া শেষে যেন দ্রুত আমদানিকারকরা পেঁয়াজ খালাস করে নিতে পারেন, সেজন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। পেঁয়াজ আমদানি আবারো শুরুর হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আহরণ যেমন বেড়েছে তেমনি বন্দর কর্তৃপক্ষের আয়ও বেড়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের আয় বাড়ায় তাদের মাঝেও কর্মচাঞ্চল্য ফিরতে শুরু করেছে।’ 

কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮-৩০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। এতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। তবে পেঁয়াজের সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে বিভিন্ন ধাপে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয় ৬ দশমিক ৬৫ লাখ টন।

হিলি স্থলবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের সংগনিরোধ কর্মকর্তা ইউসুফ আলী জানান, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার পর গত সোমবার আবারো পেঁয়াজ আমদানির আইপি দেয়া শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। দুদিন ধরে আমদানি চলছে। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেগুলোর সনদ দিয়েছি। এরপর আমদানিকারকরা সেসব পেঁয়াজ বন্দর থেকে খালাস করে নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত আইপি ইস্যু অব্যাহত রয়েছে। আমদানীকৃত পেঁয়াজ বন্দর থেকে ছাড়করণের জন্য সার্টিফিকেট প্রদানসহ যা যা সহযোগিতা করা দরকার, সেটি করা হচ্ছে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন হিলি প্রতিনিধি হালিম আল রাজী)



সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫