বাজেট ২০২৩-২৪

‘আমি ভয় করব না ভয় করব না’

প্রকাশ: জুন ০৬, ২০২৩

আব্দুল বায়েস

এক.

এটা কোনোভাবেই অতিরঞ্জিত অনুভব নয় যে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ক’মাস ধরে এক ঝাঁকুনির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেমনটি বাতাসের চাপের আকস্মিক পরিবর্তনের দরুন উড়োজাহাজে অনুভূত হয়। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত রেখে অথবা বিদ্যমান অবস্থায় অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ভবিষ্যৎ বলার মতো সমাজবিজ্ঞানীর সংখ্যা নগণ্য, যদিও এদের কেউ তথ্যপুষ্ট, কেউ তর্কনিষ্ঠ। 

এ শত শঙ্কা, হাজারো সমালোচনা এবং গভীর হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক বলয় পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম এক কঠিন সময়ে জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ সংসদে পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি; যেন স্মরণ করালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভয় বাণী—‘আমি ভয় করব না ভয় করব না’।

চারদিকে যখন অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার আভাস—হোক সে রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি কিংবা বিনিয়োগ—ঠিক তখন অর্থমন্ত্রী, সমালোচকের দৃষ্টিতে ‘বিশাল’ এক বাজেট নিয়ে সংসদে হাজির জাতির সামনে উপস্থাপনের জন্য। তবে বাজেট নিয়ে করা সদাশ্রুত মন্তব্য ‘উচ্চাভিলাষী’, ‘কঠিন সময়ে বড় প্রত্যাশা’ যে এবারের বাজেটের বেলায় আরো জোরেশোরে উচ্চারণ হবে এতে সন্দেহের কিছু নেই। তার কারণ মোট বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, ঘাটতি বাজেট ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ (গত ৯ মাসে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ), মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ (গত বছরের ৯ দশমিক ২৪ শতাংশের বিপরীতে); ঘাটতি ৫ দশমিক ১ শতাংশ (গত বছরের ৫ দশমিক ২ শতাংশের বিপরীতে)। বিশাল কিংবা বড় বাজেট এমন যুক্তি খুবই দুর্বল। কারণ ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে, আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য ও আনন্দের ব্যাঘাত হয়’—বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও তিনি শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, ঘাটতি বাজেটের বেলায় এই কথাটা খাটে। 

দুই.

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. সাদিক আহমেদ যেমনটি বলছেন, সদ্য উপস্থাপিত বাজেটের সামনে মূলত চারটি চ্যালেঞ্জ: (ক) সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা; (খ) রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ; (গ) বাজেট ঘাটতির বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং (ঘ) সামাজিক খাতের ব্যয় ধরে রাখা। 

উঁচু হারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা, অনেকটা ‘অলৌকিক’ পরিমাণের রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি, বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ এবং বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পদক্ষেপ ঘিরে সব ভাবনা ও যাতনা। স্বভাবতই সমালোচকদের ছোড়া প্রথম তীর মূল্যস্ফীতি রোধে করণীয় নিয়ে। আমরা জানি, ৯ শতাংশের ওপর মূল্যস্ফীতি নিয়ে সাধারণ নাগরিকের নাভিশ্বাস অবস্থা। সরকারি অবস্থান থেকে ‘রাজনৈতিক ব্যাখ্যায়’ বলা হয়ে থাকে যে যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটছে, কিন্তু বলা হচ্ছে না যে ২০২২ সালে পৃথিবীর অনেক দেশে, এমনকি ভারত ও থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতি সন্তোষজনক হারে নিম্নগামী। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ড. সাদিক বলছেন, ‘এসব দেশে যুদ্ধের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং বৈশ্বিক বাজারে দাম কমেছে, কিন্তু দেশে তা কমছে না।’ অনেক দেশ দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে সুদের হার বাড়ালেও বাংলাদেশ সেদিকে না যাওয়ার কারণ তিনি জানতে চান। তাছাড়া গত বছরের প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশের বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কীভাবে সম্ভব তা ভীষণভাবে ভাবায়, বিশেষত যখন সরকারকে অর্থায়নের জন্য আশ্রয় নিতে হবে তারল্য সংকটে নিপতিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নোট ছাপানোর ছাতার নিচে।

বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু এতে বিদ্যমান উচ্চমূল্যস্ফীতি থেকে মানুষকে কতটা রক্ষা করা যাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের একটি অংশ অপচয় ও অপব্যবহার হয়। সমাজের বড় একটি অংশ এখনো সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত। আবার রাজনৈতিক যোগসাজশের কারণে সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও অনিয়মের মাধ্যমে এর সুবিধা ভোগ করছে। তাছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে যে অর্থ প্রদান করা হয় বর্তমান সময়ে টিকে থাকার জন্য তাও পর্যাপ্ত নয়। 

যদি তা-ই হয় তবে, ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় যাকে বলে ক্রাউডিং আউট প্রভাব (অবশ্য মেগা প্রকল্পের কারণে ক্রাউডিং ইন প্রভাব হতে পারে) এবং অন্যদিকে ডলার সাশ্রয়ের তাগিদে আমদানি হ্রাস শিল্পায়নকে বাধাগ্রস্ত করে প্রবৃদ্ধিকে টেনে নিচে নামাবে বলে সংশয়। সুতরাং, বাজেটবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এ পরিস্থিতিতে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ‘উচ্চাভিলাষী’ এবং ‘বাস্তবসম্মত’ নয়। আর একটা কথা, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যেখানে সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন উদযাপন করার মতো, সেখানে সাড়ে ৭ শতাংশের খুঁটি ধরে কেন থাকতে হবে তা বোধগম্য নয়।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা তথৈবচ। গত অর্থবছরে যেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ শতাংশ পিছিয়ে, সেখানে এ বছর আহরণ বৃদ্ধি ৩০ শতাংশ! আর তাই বুঝি টিন (টিআইএন) থাকলেই কর দিন অর্থাৎ আয় থাকুক বা না থাকুক, বছরে ২ হাজার টাকা দিতে হবে আয় না করার কর হিসেবে। অথচ এর বিপরীতে সম্পত্তি কর সীমা ৩ কোটি থেকে ৪ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা আশা করব, জনবান্ধব এ সরকার অন্তত এ কাজ করবেন না। 

তিন.

এ দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার মতো এবং সম্প্রতি তা দ্রুত হারে বাড়ছে; প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে এন্তার অভিযোগ। স্বয়ং মন্ত্রী-এমপিরা সংসদে এ কথা স্বীকার করেছেন। বিশাল অংকের কর আদায় করা যাচ্ছে না মামলার জন্য। জাতি আশা করেছিল, অর্থমন্ত্রী চলমান এসব উদ্বেগ উৎপাটন বা উপশমে কার্যকর পদক্ষেপের কথা তুলে ধরবেন, রোডম্যাপ আঁকবেন কিন্তু তা দেখা গেল না। ‘কালো টাকা সাদা’ করার ‘অনৈতিক’ নীতিমালার ক্ষেত্রে অগ্রগতি বা অধোগতি সম্পর্কেও তিনি ছিলেন নিঃশব্দ যা সমালোচকদের দৃষ্টি এড়ায়নি।

আসলে ব্যাপক আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সংস্কার আনয়ন ব্যতীত উল্লিখিত সমস্যাগুলো দূর করার কাজটি দুরূহ এবং প্রবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া সম্ভব নয়। কারো শর্তে বাধ্য হয়ে সংস্কার করা এক কথা আর স্বতঃস্ফূর্ততা এবং অন্তরের তাগিদে সংস্কার সাধন অন্য কথা। 

চার.

বাজেটে কৃষি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রত্যাশিত থাকলেও বাস্তবে কমেছে। অথচ যেমনটি বলছেন অধ্যাপক সেলিম রায়হান—এ দুই ক্ষেত্রেই বরাদ্দ কমানো সমর্থনযোগ্য নয়। চলমান বৈশ্বিক সংকটে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের আশঙ্কা বাড়ায় খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। বিশেষত কৃষি খাতে বরাদ্দ কমানোর বিষয়টি বোধগম্য নয়। উচ্চমূল্যস্ফীতির এ সময়ে বাজারে কৃষিজ পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সেজন্য কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে নানাভাবে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয়াটাই তো যুক্তিযুক্ত।

পাঁচ.

‘উন্নয়ন অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ প্রায় ২৫০ পৃষ্ঠার বাজেট ভাষণের শুরুটা যেমন চমৎকার শেষটাও তেমনি মনোমুগ্ধকর। রাজস্ব সংগ্রহে নতুন খাতে দৃষ্টি দেয়া, বাজেট ঘাটতি নির্বাহে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি/প্রণোদনা যৌক্তিক করা, কৃষির আধুনিকীকরণে জোর দেয়া এবং দারিদ্র্য বিমোচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ বাজেট উপস্থাপন করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘আশা করা যায় এ বাজেট বাস্তবায়নে অর্থনীতি আরো শক্তিশালী ও বেগবান হবে। স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার এবং সর্বোপরি স্মার্ট অর্থনীতি গঠনের পথ সুগম হয়।’

কিন্তু যত বিপত্তি ওই বাস্তবায়নে। আমরা অর্থমন্ত্রীর আশাবাদ সফল হোক এ কামনাই করি। গত ১৪ বছর তিনি এবং তার সরকার যে দক্ষতার সঙ্গে ধেয়ে আসা সংকট, যেমন করোনা এবং অধুনা বৈশ্বিক সরবরাহ বিপর্যয় মোকাবেলা করেছেন সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, যা প্রশংসার দাবি রাখে। 


আমি ভয় করব না ভয় করব না।

দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না॥

তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে—

তাই ব’লে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না॥

শক্ত যা তাই সাধতে হবে, মাথা তুলে রইব ভবে—

সহজ পথে চলব ভেবে পড়ব না, পাঁকের ‘পরে পড়ব না॥

আব্দুল বায়েস: অর্থনীতির অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫