রাজস্ব আয় বাড়ানোর সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়েছে

প্রকাশ: মে ৩০, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বৃহদায়তনে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিভিন্ন সময়ে মধ্যম ও স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি রাজস্ব আহরণে প্রযুক্তিনির্ভরতা বৃদ্ধি এবং আয়কর ও ভ্যাটের আওতা বাড়ানোরও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যদিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না এনবিআর। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সংস্থাটির রাজস্ব আহরণে ঘাটতি রয়েছে সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। 

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১০ মাসে প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়েছিল এনবিআর। যদিও এ সময়ের মধ্যে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণ হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। এনবিআরের সাময়িক রাজস্ব আহরণ বিবরণীতে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণে ঘাটতি রয়েছে ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যের প্রায় ৮৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ আহরণ করতে পেরেছে সংস্থাটি। 

রাজস্ব খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি, এলসিতে কড়াকড়ির মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে এবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য খাত থেকে রাজস্ব আহরণ কমেছে এনবিআরের। পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে মূসক এবং আয় ও ভ্রমণ করে আহরণ আরো বেশি হওয়ার সুযোগ ছিল।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল এনবিআর। এর মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে আহরণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী লক্ষ্য পূরণ করতে অর্থবছরের বাকি দুই মাসে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা আহরণ করতে হবে সংস্থাটিকে। এজন্য প্রতি মাসে গড়ে রাজস্ব আহরণ করতে হবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। 

অর্থবছরের বাকি সময়ে এ লক্ষ্য পূরণ করা এক প্রকার অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এনবিআরের তথ্যের সূত্র দিয়ে তারা বলছেন, গত অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম ১০ মাসে লক্ষ্যের বিপরীতে রাজস্ব আহরণে ঘাটতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। এখন তা সম্প্রসারণ হয়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। 

সামনের দিনগুলোয়ও যদি এ ঘাটতির হার সম্প্রসারণ হতে থাকে তাহলে সরকারের ঋণনির্ভরতাও আরো বেড়ে যাবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের সবচেয়ে বড় নির্ভরশীলতার ক্ষেত্র হলো রাজস্ব আহরণ। লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ না হলে সরকারের ঘাটতি বাজেট সম্প্রসারণের প্রয়োজন পড়ে। এ ঘাটতি পূরণে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণগ্রহণ বাড়াতে হয় সরকারকে। বর্তমানে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের অন্যতম বৃহৎ একটি ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধ। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘‌এ ঘাটতির বিষয়টি প্রতি বছরই হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে ঘাটতি অর্থায়নের বিষয়টিও নতুন নয়। উন্নয়নকে যখন এগিয়ে নিতে হয় তখন ঘাটতি বাজেট করতে হয়। এছাড়া চাহিদা তৈরি করতে এবং অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতেও ঘাটতি বাজেট করা হয়। এটিকে ব্যবস্থাপনা করাই হলো আসল কথা। রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ইচ্ছা করেই বেশি নির্ধারণ করা হয়, যাতে আরো বেশি আদায় করা সম্ভব হয়, যাতে করে আমরা আরো ভালো আদায় করতে পারি। লক্ষ্য বড় হলে আদায়ও বেশি হবে। তবে অন্তর্নিহিত কিছু দুর্বলতার কারণে আমাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারি না। এছাড়া আরো কিছু দুর্বলতা আছে, যেগুলো আমাদের জ্ঞানের বাইরে। যেমন কভিড কখন আসবে তা কেউ জানত না। এ রকম অনিশ্চিত কিছু পরিস্থিতি আছে। আমরা বড় কোনো ভুল করিনি এবং সঠিক পথেই আছি।’ 

এনবিআরের রাজস্ব আহরণের উৎস তিনটি। আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে শুল্ক, পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে পণ্যের ওপর আহরিত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও আয়কর এবং ভ্রমণ কর। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মূসক এবং আয়কর ও ভ্রমণ করে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশের ওপর থাকলেও আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক আহরণ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশেরও কম। শুল্ক খাতে এ সময় ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ১২৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এছাড়া মূসকে ১০ হাজার ১৩৬ কোটি ১২ লাখ এবং আয় ও ভ্রমণ করে ৫ হাজার ৩৬৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঘাটতি ছিল। 

সব মিলিয়ে এ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মূসকে—১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি শুল্ক আদায়ে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আয় ও ভ্রমণ করে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। 

রাজস্ব খাতে আমদানি-রফতানি শুল্ক ও মূসকের ওপর অতিনির্ভরতা কাটিয়ে এনবিআরের এখন কর আহরণ বাড়ানোয় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশে মূসকের অবস্থান শীর্ষে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে শুল্ক আয়। কর আহরণ হয়েছে সবচেয়ে কম। যদিও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় আয়কর খাতের অবস্থান থাকে সবার ওপর। গোটা বিশ্বে কর-জিডিপি অনুপাতে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। 

আইএমএফের ঋণের শর্তেও কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এটিকে সাড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

এনবিআরের মাসিক রাজস্ব আদায়ের তথ্যানুযায়ী, এপ্রিলে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ৪০৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আহরণ হয়েছে ২৪ হাজার ৭৮১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী এপ্রিলে লক্ষ্যের বিপরীতে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৬২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘাটতি ছিল শুল্ক আদায়ে—৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। মূসক আদায়ে ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। আয় ও ভ্রমণ করে ঘাটতির পরিমাণ ৪১১ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

রাজস্ব আহরণে ঘাটতিকে দেশের শিল্প খাতের অন্তরায় হিসেবে দেখছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌রাজস্ব আহরণ সন্তোষজনক না হলে সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ফলে বেসরকারি খাত সেভাবে ঋণ পায় না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এটি একটি বড় অন্তরায়।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘‌চলতি অর্থবছরের আগে থেকেই সারা বিশ্বে ডলারে ব্যাপক সংকট ছিল। ফলে সরকার অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার একটা চেষ্টা করেছে। সেজন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে নানা কড়াকড়ি এসেছে, নিষ্পত্তিও কমেছে। ফলে আমদানি ঋণাত্মক হওয়ায় এ খাত থেকে শুল্ক আদায়ও কমেছে। তবে ভ্যাট ও আয়কর আদায়ে এনবিআরের আরো ভালো করার সুযোগ ছিল।’ 

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আরো কিছু সংস্কার ও পদক্ষেপের বিষয়েও আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। গত কয়েক বছরে রাজস্ব আহরণে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে। তাই আইএমএফের প্রোগ্রামের আওতায় বাড়তি রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এনবিআর কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিলেই তা পূরণ করা সম্ভব। আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে প্রাথমিক কাঠামো দাঁড় করা হয়েছে বলেও আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে রয়েছে ই-পেমেন্ট, ই-রিটার্ন ফিলিং, ই-টিডিএস, ই-অফিস ম্যানেজমেন্ট ও ই-টিআইএন সিস্টেম।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘‌এডিপি বাস্তবায়ন করার পরও সরকারের যে রাজস্ব আসার কথা, তা আসছে না। এডিপির সঙ্গে কর আদায় মিলছে না। খরচ ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এর অর্থ এনবিআর ঠিকমতো আদায় করতে পারছে না। এখানে করদাতা না আসা একটি বড় কারণ। আরেকটি হচ্ছে, সরকার বড় পরিমাণ অর্থ কর অবকাশ দিয়ে দিচ্ছে। এনবিআরের কর আদায় বাড়াতে অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সেগুলো ঠিকমতো শেষ হয়নি, যার জন্য সেসব প্রকল্পের সুফল নিতে পারেনি এনবিআর। এছাড়া কর আদায় বাড়াতে এনবিআরের জনবলও বাড়াতে হবে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫