স্বাস্থ্যবিধি ও সুস্বাস্থ্য

হাইজিনকে নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে

প্রকাশ: মে ২৯, ২০২৩

অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও লাইন ডিরেক্টর (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ)। সরকারের বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তিনি। রোগ, রোগী ব্যবস্থাপনা ও সংক্রামক বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও সুস্বাস্থ্যের জন্য হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব, কার্যক্রম ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

রোগ প্রতিরোধ সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যবিধি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

রোগ প্রতিরোধ সুস্থতার জন্য স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কারণ ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধিও সুরক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। স্বাস্থ্য ভালো রাখা, রোগ প্রতিরোধ সুস্থতার জন্য এটা প্রয়োজন। যদি একটা উদাহরণ দিই, সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার যে বিষয়টা, টয়লেট ব্যবহার করে এটা করার যেমন একটা সুফল আছে, তেমনি করোনার সময় আমরা দেখেছি কাজের জায়গা থেকে এসে বা বাইরে থেকে এসে হাত ধুতে বলা হয়েছে। বারবার হ্যান্ড স্যানিটাইজ করতে বলা হয়েছিল। কেউ সাবান ব্যবহার করেছেন, কেউ অন্য কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করেছেন। তবে উদ্দেশ্য সেখানে একই ছিল, জীবাণু থেকে নিজেকে রক্ষা করা। একইভাবে আমরা কিছু সংক্রামক রোগের কথা জানি। এগুলো মানুষ থেকে মানুষে, প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়। অন্য কোনো বস্তু থেকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। পানি থেকে ডায়রিয়ার মতো রোগ ছড়ায়। সুপেয় পানি দিয়ে যদি পান করাসহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ করা যায় তাহলে সেটা মানুষের রোগ প্রতিরোধ থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেজন্য বলাই যায় সুস্বাস্থ্য রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সেটা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই না, খাবারের ক্ষেত্রে হতে পারে। বসবাসের জায়গার ক্ষেত্রে হতে পারে। নখ কাটা থেকে শুরু করে একজন রোগীকে দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সেটা মেনে চলা জরুরি।

স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত?

স্বাস্থ্যবিধি গ্রিক সভ্যতা থেকে এসেছে। এর মধ্যে বেশকিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত। যেমন হাত ধোয়ার কথা বললাম, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি আছে। খাবার তৈরি করা, সংরক্ষণ করা, সেখানেও স্বাস্থ্যবিধির ভূমিকা আছে। আমি যদি বলি খাবার শেষে বর্জ্যটা ফেলে দেব সেখানেও স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপার আছে। খাবার আলাদা রাখা, সেটি ঠিক সময়ে গরম করা, রান্নাঘর পরিষ্কার করার মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি আছে। মানুষের জীবন ধারণ, বসবাসের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি জড়িয়ে আছে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির কথা তো শুরুতেই বললাম। দাঁত মাজা থেকে শুরু করে হাত ধোয়া, গোসলখানা, টয়লেট, বাথরুম সব জায়গায় এটা করতে হয়। সবার বেলায় সব অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দরকার।

দেশের সরকারি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যবিধির ব্যবস্থাপনা কি গুরুত্ব সহকারে করা হচ্ছে?

প্রশ্ন খুব কঠিন জটিল। কেননা আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান যেগুলো আছে তার তৃণমূল থেকে শুরু করে টারশিয়ারি (বিশেষায়িত) পর্যায়ে সুপার স্পেশালাইজড প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত আছে। বেসরকারিতে করপোরেট লেভেলের হাসপাতাল যেমন আছে, তেমনি প্রান্তিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানও আছে। তাই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করি রক্ষা করার কিন্তু আমাদের প্রতিটি হাসপাতালই, আমরা বেড অকুপেন্সি (শয্যায় রোগী ভর্তির হার) জরুরি বিভাগের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব, সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি রোগীকে আমাদের সেবা দিতে হয়। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত যে মাত্রায় হাইজিন মেইনটেইন করার কথা, সে অনুসারে অনেক ক্ষেত্রে করা হয়ে ওঠে না। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কথা আমি না- বলি, সেগুলোর কথা তো আমরা সবাই জানি। কাজেই, জায়গায় উন্নতি করার অনেক সুযোগ রয়েছে এবং তা করার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি।

প্রাথমিক মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে পড়ানো হয়। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে কি?

প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে যারা পড়াশোনা করে তাদের শেখানোর ব্যাপারটা প্রাথমিক মাধ্যমিক অধিদপ্তরই দেখাশোনা করে। আর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শ্রেণী শিক্ষক বা বিজ্ঞান শিক্ষক তাদের এসব শিখিয়ে থাকেন। আমাদের স্কুল হেলথ কর্মসূচি নামে একটি কর্মসূচি আছে কিন্তু সেটি অত্যন্ত সীমিত আকারের। সেখানে তাদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমাদের শিশুরাও এসব বিষয়ে অভিভাবক, ভাই-বোনদের কাছে বার্তাগুলো নিয়ে যায়। আর বছরে দুবার ব্যাপকভাবে স্কুলের শিক্ষার্থীদের কৃমির বড়ি সেবন করানো হয়। কাছাকাছি সময়ে আরেকটি প্রকল্প রয়েছে, খুদে ডাক্তার আমরা যাকে বলি, সেখানে চার কোটির মতো শিশুর চোখ পরীক্ষা, উচ্চতা মাপা, অপুষ্টিতে ভুগছে কিনা তা জানানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জানানো হয়। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষভাবে এসব কাজে সরকারের অবদান আছে। পাশাপাশি শিক্ষক অভিভাবকও এর মাধ্যমে ছোট শিশুদের সম্পর্কে শিক্ষা দেন। এখানে অভিভাবকদেরও ভূমিকা আছে। শুধু স্কুল থেকে শিখে আসলেই তো হবে না, বাড়িতেও তা করতে হবে। আমি মনে করি একে সামাজিক আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে গেলে তা আরো বেগবান হবে।

পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি কিশোরী তরুণীদের প্রজনন স্বাস্থ্যে কেমন প্রভাব রাখতে পারে?

এটা শুধু কিশোরীদের জন্য না কিশোরদের জন্যও প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সামষ্টিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এগুলোকে একেবারে নিত্যদিনের অভ্যাস হিসেবে পরিণত করতে হবে। না হলে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। যেমন চর্মরোগ, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (মূত্রনালির সংক্রমণ) অথবা অন্য কোনো ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। এটি তার সুস্বাস্থ্য গড়ার প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে পারে। কাজটি শিশু-কিশোর বয়স থেকে শুরু করা না গেলে তাদের বেড়ে ওঠা, স্বাস্থ্য এমনকি মানসিক গড়নেও প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশে নীতিগত পদক্ষেপগত সীমাবদ্ধতা কী কী রয়েছে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) যে মানদণ্ড সেটি মেনে চলতে পারলে খুব ভালো। আমরা চাই যে সে মানদণ্ড অল্পদিনের মধ্যে আমরা অর্জন করি। তবে এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বহুমুখী। সেখানে সবাইকে সুষম একটি ব্যবস্থায় নিয়ে আসার ব্যাপারটি বেশ কঠিন। সুষম করার জন্য ৫০ বছর ধরে কাজ করা হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে তবে আরো উন্নতি করার সুযোগ আছে। আগের চেয়ে এখন সেটা ইতিবাচকভাবে করা হচ্ছে। আর নীতিগত যে বিষয়টি বলছেন সেটা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যখন যেটি করা প্রয়োজন তা করতে সরকার কখনো দ্বিধাবোধ করেনি। এখানে সরকারের সবিশেষ মনোযোগ রয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

ব্যক্তিকে যদি এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সে যদি সঠিক চর্চা করে তবে তার পরিবারও সেখানে যুক্ত হয়। পরিবারটি স্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকবে। এভাবে ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, একজন আরেকজনকে সহায়তা করলে আমাদের সীমিত সম্পদের মাঝে থেকেই আমরা স্বাস্থ্যবিধিগুলো যথাযথভাবে পালন করতে পারি এটি মেনে চললে ব্যক্তির সুস্থ থাকার পাশাপাশি জাতিগতভাবে উন্নতি করা যায়। সরকার উন্নয়ন সহযোগীরা নিয়ে কাজ করছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫