ব্যাংকিংয়ে নৈতিকতা ও সুশাসন

ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হোক

প্রকাশ: মে ২৬, ২০২৩

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের টানাপড়েন চলছে। এরই মধ্যে দেশের ব্যাংক খাতের নানা সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঋণখেলাপির সমস্যা। ব্যাংক খাতকে আরো নাজুক করেছে আর্থিক লুণ্ঠন, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং খাতটিতে সুশাসনের অভাব। এক কথায় দেশের ব্যাংক খাত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। রাজধানীতে দুদিনব্যাপী ‘ব্যাংকিং অন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংক খাতে নৈতিকতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সুশাসন নিশ্চিত ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের শক্তিশালী ভূমিকাই খেলাপি ঋণ সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে।’ প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে জানান, দেশের মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ আর শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকাও তুলে ধরেন তিনি। এ শীর্ষ খেলাপিদের কাছে মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তাই এটা বলা যায় যে বর্তমানে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা সমাধানে আমাদের ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। এদিকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। ফলে খেলাপি ঋণও কমেনি। বিশ্বের সব দেশেই ব্যাংক খাতকে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বিবেচনা করা হয়। আর তাই আমাদের দেশের ব্যাংক খাতে বিদ্যমান খেলাপি ঋণ কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের যেকোনো মূল্যেই হোক খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতেই হবে এবং যথাযথ ব্যাপক সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে করপোরেট সুশাসন ও খেলাপি ঋণ। এর সমাধানে আমাদের প্রয়োজন ব্যাংকিং আচরণে নৈতিকতার চর্চা, ব্যাংক কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সুশাসন নিশ্চিত করা। ব্যাংকিং নীতিমালা বাস্তবায়ন ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের শক্তিশালী ভূমিকা খেলাপি ঋণ সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে।’ মূলত তিনি দেশের ব্যাংকের দুরবস্থা মোকাবেলায় পরামর্শগুলো দিয়েছেন। দেশের ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এটি মূলত দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এক সমস্যা। খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে এ খাতকে মুক্ত করতে অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমান অর্থমন্ত্রীও নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। পরিবর্তন আনা হয়েছে ঋণবিন্যাসের সংজ্ঞায়, বাড়ানো হয়েছে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়। ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য জারি করা হয়েছে বিশেষ নীতিমালা। এ নীতিমালার আওতায় রেকর্ডসংখ্যক ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। তবু কমানো যায়নি খেলাপি ঋণ। বরং নতুন করে এটি আরো বেড়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্প্রতিক সময়ে সরকার যতগুলো উদ্যোগ নিয়েছে, তার সবক’টিই অকার্যকর হয়েছে। ঋণখেলাপিদের সংখ্যা না কমিয়ে ব্যাংক খাতের রোগ একবারে সারানো সম্ভব হবে নয়।

ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখা উচিত যে ঋণগ্রহীতার কারণে যেমন কোনো একটি ঋণ খেলাপি হয়, তেমনি ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেও কোনো ঋণ খেলাপি হতে পারে। আরো কিছু কারণের মধ্যে ব্যাংক খাতে ওভারড্রাফটের মাধ্যমে ঋণ দেয়া হচ্ছে, এটা যেকোনো ভালো ঋণকে খেলাপি ঋণে পরিণত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ওভারড্রাফটের মধ্যমে গৃহীত ঋণের অর্থ ব্যবহারের ওপর ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংক কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এছাড়া সাধারণ নিয়ম হলো যে একজন ঋণগ্রহীতা ঋণের ওপর প্রদেয় সুদ নগদে পরিশোধ করবেন। কিন্তু তা না করে ব্যাংকঋণের ওপর প্রদেয় সুদ ঋণগ্রহীতার ঋণস্থিতির সঙ্গে যোগ করে ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়—এটি কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নয়। এ পদ্ধতিও ঋণখেলাপি হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়া আমাদের খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করার পদ্ধতিটিও আধুনিক নয়। আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ল্যাসিফিকেশন অব লোনস তৈরি করে, যার মাধ্যমে তাদের প্রদত্ত ঋণের শ্রেণীবিন্যাস করা হয় এবং সে অনুসারে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সম্পূর্ণ বা শতভাগ প্রভিশন কখনই রাখা হয় না। ফলে শুরু থেকেই এক ধরনের প্রভিশন ঘাটতি বিরাজ করে। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ছদ্মবেশী খেলাপি ঋণ একটি মারাত্মক সমস্যা। তথাকথিত পুনঃতফসিলের সুযোগ নিয়ে এসব নিম্নমানের ঋণকে ভালো ঋণ হিসেবে দেখিয়ে দুই ধরনের ক্ষতি সাধন করা হয়। একদিকে এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় না। অন্যদিকে এ ঋণের ওপর অর্জিত সুদ নগদে আদায় না হওয়া সত্ত্বেও ঋণস্থিতির সঙ্গে যোগ করে ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়। যখন সত্যিকার অর্থেই এগুলো খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয় তখন অবলোপন করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রভিশন থাকে না। এছাড়া আছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, দুর্নীতির মাধ্যমে গৃহীত ঋণখেলাপি, ঋণ জালিয়াতিসহ নানা ঘটনা আছে, যার কারণে আমাদের দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এছাড়া ঋণ বিতরণে যে ভারসাম্যপূর্ণ শৃঙ্খলা থাকা দরকার সেটি ভেঙে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয়। বড় গ্রহীতাদের আগ্রাসী ঋণ দিয়েছে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই। এতে লঙ্ঘিত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সীমা। বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক লিমিটেড নির্ধারিত সীমার বেশি ঋণ দিয়েছে বড় গ্রহীতাদের। বিগত কয়েক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেই বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে। ফলে এ বিষয়ে আরো সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ঋণ প্রদানে বিদ্যমান বিধান পরিপালনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উদাসীনতা কারো কাম্য নয়। আসলে ব্যাংকের ঋণশৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বেনামে ঋণ। দেশে খেলাপি ঋণ বিস্তারের অন্যতম কারণ অব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ। আধিপত্যের কারণে ব্যাংক খাতে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি ঋণখেলাপির ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে দূরে রাখতে আইনের কঠোর প্রয়োগ, জবাবদিহি ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করারও দাবি রয়েছে অনেক আগে থেকে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড সূক্ষ্মভাবে তদারক করতে হবে। 

ব্যাংক খাত আজ সমস্যায় জর্জরিত। সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের ঘাটতি। ব্যাংক খাতে কারসাজি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, পরিচালকদের মধ্যে আন্তঃব্যাংক ঋণ আদান-প্রদান, ব্যাংক পরিচালনা থেকে শুরু করে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে ব্যাংক খাতে। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের আরো সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে সবাই। ব্যাংক খাতের জন্য যেসব নীতিমালা, আইনকানুন, আন্তর্জাতিক রীতি আছে, সেগুলো সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক খাত জড়িত। এ খাতের উন্নয়ন না হলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। আর্থিক কাঠামো দুর্বল হবে। ব্যাংক খাতের এ দুর্দশা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এ খাতকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা এখন খুবই জরুরি।

ব্যাংক খাতকে যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বিবেচনা করা হয়। আর সে খাতই যদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে বাধ্য, যার আলামত নানাভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাজেই বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে যথাসম্ভব দ্রুত ব্যাংক খাতকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পড়বে ব্যাংক খাতে অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা। একটি শক্তিশালী নৈতিক সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংক খাতে যদি আবারো বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আনাতে পারে, তাহলেই ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫