‘নভেরার কথা মনে পড়ে কারো!’

প্রকাশ: মার্চ ২৯, ২০২৩

সৈয়দ শামসুল হক

‘নভেরার কথা মনে পড়ে কারো!’—এই আশ্চর্যবোধক বাক্য দিয়ে শুরু করেছেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ তাঁর নতুন কবিতাটি—বেরিয়েছে ‘সংবাদ’-এর একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ সংখ্যায়। নভেরা? সে কে? সত্যিই তো নভেরার কথা আজ আর কে মনে রাখে? কী এমন দায় আছে কার যে নভেরার কথা মনে রাখবে? বিস্মৃতিই হয় আমাদের ‘মূল্যবান’ পরিচ্ছদ এবং সত্য গোপনই হয় আমাদের ‘প্রিয়তম’ খেলা।

নভেরা—নভেরা আহমেদ—আমাদের এই বাংলাদেশে ভাস্করদের মধ্যে প্রথম তিনি এবং আমার মনে হয় এখনো তাঁর তুল্য একজন ভাস্কর এ দেশে আসেননি: খ্যাতি অর্থ নয়, পাশ্চাত্যের অনুকরণ নয়—তাঁর কাজের একমাত্র প্রেরণা ছিল যেন স্রষ্টারই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বস্তুরূপ নতুন করে সৃজন করা এবং তিনি ছিলেন বিরূপ পরিবেশে প্রকৃত প্রতিভাধরের মতোই অভিমানতাড়িত একজন, যিনি স্বেচ্ছায় সব ছেড়ে যেতে পারেন, এমনকি সৃষ্টির দুটি হাত। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল নকশাটি তিনি করেছিলেন চিত্রকর হামিদুর রহমানের সঙ্গে মিলিতভাবে।

এই শহীদ মিনারের মধ্যভাগে শোকে অবনত মা এবং দু’পাশে তাঁর দুটি করে সন্তান; তারা বাস্তবানুগ নয়, বিমূর্ত, বন্দী স্বদেশের লৌহগরাদের অবিকল স্মৃতির মিনার রচনায় আমাদের এতকালের যাবত নকশা ছিল ইসলামী বা ভারতীয়, যেমনটি দেখা যায় গোরস্তানে বা শ্মশানে কিংবা পাশ্চাত্যে সূচীমুখ স্তম্ভে এবং তাও খ্রিষ্টীয়, এ সকলই কী অসাধারণ কল্পনাবলে বর্জন করে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ একটি মিনার-কল্পনা, ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি, করেছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। নভেরাই নকশাটিকে প্রথম কল্পনা করেন, হামিদুর রহমানের সঙ্গে সেই সময়ে ছিল নভেরার বিশেষ সখ্য এবং তাঁরা মিনার-নকশার কাজে ছিলেন যৌথভাবে নিবিষ্ট; আমাদের বয়সীরা এখনো ভুলে যাইনি যে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা হামিদুর রহমান একা করেননি, নভেরাও সমঅংশে সঙ্গে ছিলেন এবং নকশাটির বীজ উপ্ত হয়েছিল প্রথমত নভেরারই করোটিতে।

অথচ নভেরার নাম আমরা করি না, কেবল হামিদের নাম করে থাকি। এখন প্রয়াত হামিদ আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু হলেও তাঁর মৃত্যুর আগেও তাঁকে বহুবার বলেছি এবং এখনো বলছি তাঁর আত্মার প্রতি আমার সকল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রেখেই যে তিনি নিজেই শহিদ মিনার প্রসঙ্গে কখনো নভেরার নাম গুরুত্ব দিয়ে উচ্চারণ করেননি, সবটুকু কৃতিত্ব নিজের জন্যে দাবি করেছেন, এমনকি বেশ কয়েক বছর আগে টেলিভিশনে আমি একবার যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিই, তখনো আমার বারবার ধরিয়ে দেয়া সত্ত্বেও তিনি নভেরার ভূমিকাকে তুচ্ছ করেছেন, উড়িয়ে দিয়েছেন, নভেরাকে কেবল তাঁর এক দীপ্তিহীন সহকারী বলে উল্লেখ করেছেন।

তবে কি নভেরার সঙ্গে হামিদের যে সখ্য ছিল, গূঢ় কোনো কারণে তাতে ধরেছিল শুশ্রূষার অতীত কোনো চিড়, অভিমানে নভেরা নিয়েছিলেন সর্ব অর্থে বিদায়, দাবি আর করেননি কোনো প্রীতি কি পুরস্কার, হামিদ তাই একাই গ্রহণ করতে চেয়েছেন মিনার রচনার সবটুকু সম্মান? এক ইংরেজি পত্রিকায় এবারের একুশের দিনে এক পাতা জোড়া নিবন্ধে হামিদুর রহমানের কনিষ্ঠ ভাই নাট্যকার সাইয়িদ আহমদ শহিদ মিনারের মূল নকশা ও পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত বললেও নভেরাকে তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান আদৌ দেননি, অথচ সাইয়িদ আহমদেরই তো জানবার কথা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো করে যে, হামিদ ও নভেরা, কার ভূমিকা ছিল কতটুকু। আমি ক্রুদ্ধ।

নভেরাকে খুব কাছে থেকে জানতেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ; আতীকুল্লাহর যে ধরনের কবিতায় এখন আমরা অভ্যস্ত তা থেকে গভীর মর্মিতা ও বেদনায়, তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ নতুন এক উচ্চারণ ধারণ করে, তিনি লিখেছেন নভেরার উদ্দেশ্যে আর্ত একটি কবিতা; তিনি বললেন—‘কী অভিমানিনী সে আসে না কোনোদিন শহিদ মিনারে’, বলছেন—

‘শহিদ মিনার কী করুণ ডাকে সেই নভেরাকে

কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার

কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার

কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার।’

আমার ক্রোধ প্রশমিত হয়ে যায়; অন্তত একজন আতীকুল্লাহ আছেন যিনি একুশের দিনে নভেরাকে আত্মার ভেতর থেকে আজও তুলে আনেন।


লেখার এ অংশটুকু সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যকলামের সংকলন ‘হৃৎকলমের টানে’ গ্রন্থ থেকে নেয়া


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫