সাক্ষাৎকার

চার বছর বয়সে অবশ্যই শিশুর চক্ষু পরীক্ষা করাতে হবে

প্রকাশ: মার্চ ২৭, ২০২৩

ডা. তারিক রেজা আলী। বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতির মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের রেটিনা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে এ চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপনা, গবেষণা ও চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত। শিশুদের চোখের চিকিৎসার বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কাজ করছেন। শিশুদের চোখের সমস্যা, চিকিৎসা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

শিশুদের চোখে কী কী সমস্যা হয়?

অনেক নবজাতক চোখ ওঠা রোগ নিয়ে জন্মায়। সেটাকে বলা হয় নিওন্যাটাল কনজাংটিভাইটিস। এতে চোখে অনেক ময়লা হয়। আবার অনেক শিশু নেত্রনালির সমস্যা নিয়ে জন্মায়। তাদের চোখ দিয়ে সবসময় পানি পড়ে। এটা এক চোখে বা দুই চোখেই হতে পারে। এছাড়া চোখের ভেতরের একটা রোগ হয় অনেক শিশুর। সেটার নাম রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিউরিটি। প্রথম দুটি রোগে শিশুর দেখার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। তবে তৃতীয় রোগটিতে আক্রান্ত শিশু যদি সঠিক চিকিৎসা না পায় তাহলে অন্ধও হয়ে যেতে পারে। ৩৫ সপ্তাহের আগে যেসব শিশুর জন্ম এবং ওজন দুই কেজির কম তারা বেশি রোগের ঝুঁকিতে থাকে। এসব শিশুর বেশির ভাগকেই আমাদের আইসিইউতে রাখতে হয়। সেখানে তাদের অক্সিজেন দেয়া হয়। রেটিনার রোগ তৈরি করে সেটিই। রেটিনা হলো চোখের ভেতরের একটি পাতলা পর্দা। সেখানে আলো পড়লে আমরা দেখতে পাই। শিশুর রেটিনা বেড়ে উঠতে একটু সময় লাগে। পূর্ণ সময় পার করে জন্ম নেয়া শিশুদেরও রেটিনা তৈরি হতে চার সপ্তাহের বেশি সময় লাগে।

শিশুদের এসব সমস্যা কি জন্মগত? শিশুদের চোখের সমস্যার পেছনে আর কী কী কারণ রয়েছে?

চোখের প্রথম দুটো রোগ জন্মগত। পরের রোগটার ক্ষেত্রে সন্তান যদি আর দুই সপ্তাহ মায়ের পেটে বেশি থাকতে পারত তাহলে রোগটা হতো না। এটা জন্মগত নয়, এটা শুধু প্রিম্যাচিউর হওয়ার জন্যই হচ্ছে।

বর্তমানে খুব অল্প বয়সেই শিশুদের চোখে চশমা দিতে দেখা যায় কেন?

এটা আরেকটা রোগ। এটা নিয়ে আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে করোনার দুই-তিন বছর শিশুরা ঘরেই বসে ছিল। অনেক বেশি সময় তারা টেলিভিশন বা মোবাইল স্ক্রিন এসব দেখেছে। এভাবে বেশি নিকটে দৃষ্টি দেয়ার জন্য আমাদের ধারণা শিশুগুলোর বেশি বেশি মায়োপিক হয়ে যাচ্ছে, তাতে করে চশমা পরার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান বা কোরিয়ায় প্রচুর মায়োপিক শিশু রয়েছে, আমাদের দেশেও সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী তা বলা খুবই কঠিন। তবে এটা একটা জন্মগত রোগ, অর্থাৎ জেনেটিক যে বিষয়টা ক্রোমোজোমাল, সেটা নিয়েই তারা জন্মগ্রহণ করে।

কোন বয়সে সাধারণত শিশুর দৃষ্টি প্রসারিত হতে থাকে?

ছয় মাস পর্যন্ত শিশু চোখে তেমন দেখেই না। এর পর থেকে ধীরে ধীরে তার দেখার ক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং চার বছর বয়সে গিয়ে সেটা পরিপূর্ণতা পায়। চার বছর বয়সে আমরা শিশুদের স্কুলে দিই। স্কুলে দেয়ার আগে তার চশমা লাগে কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আমরা এমন অনেক শিশু পাই, যাদের বয়স - বছর হয়ে গেছে, তখন শিক্ষক খেয়াল করেন ভালো করে দেখতে পায় না। তখন হয়তো তার বাবা-মাকে জানায়। ততদিনে তিন-চার বছর চলে গেছে। সেই চিকিৎসাই যদি তিন-চার বছর আগে দিতাম তাহলে চোখের ওই খারাপ অবস্থা হতো না। অবস্থাকে বলা হয় এমব্লায়োপিয়া বা অলস চোখ। সঠিক সময়ে চিকিৎসা দিতে না পারলে চোখটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। তাই চার বছর বয়সে অবশ্যই শিশুর চক্ষু পরীক্ষা করতে হবে। তাহলে সঠিক সময়ে শিশুকে চিকিৎসা দেয়া যাবে।

শিশুর চোখের সমস্যার চিকিৎসা না হলে কী ধরনের শারীরিক জটিলতা হতে পারে?

রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিউরিটির কথাই বলি। প্রিম্যাচিউর শিশুদের নিউরোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট একটু ধীর হয়। তাদের বুদ্ধির বিকাশ কম হয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা হাঁটতে কম পারে। দেখা যায় এক বছর, দেড় বছর, দুই বছর সময় পার হয়ে যাচ্ছে সে দাঁড়াতেই পারে না। কোনো শিশু যদি দূরে কম দেখে তাহলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন অন্য শিশুদের তুলনায় কম হবে। তার আইকিউ বা সাইকোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্টও কম হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেজন্য চোখের চশমা দরকার হলে সেটা দেয়া জরুরি। আবার অন্যান্য কোনো রোগ যেমন জন্মগত ছানিও এখন প্রচুর দেখা যাচ্ছে। অনেক শিশু বলে যে দুই চোখেই দেখে না, সাদা সাদা দেখে। ছবি তুললেও সাদা একটা রিফ্লেক্টস দেখা যায়। সেটা ছানিও হতে পারে, আবার কঠিন একটা রোগ আছে যেটার নাম রেটিনোব্লাসটোমা, সেটাও হতে পারে। এটি রেটিনার একটা ক্যান্সার, যা জীবন সংহারী।

শিশুর চোখের সমস্যার জন্য বড়দের অসচেতনতা কতটুকু দায়ী?

এসব রোগ বাবা-মা বা নানি-দাদি প্রথমে খেয়াল না করলে আমরা তাদের দোষ দেব না। তবে শিশুর মাইনাস পাওয়ার হয়ে যাচ্ছে, তারা - বছরে গিয়ে খেয়াল করছে। সেটা কিন্তু মা-বাবার অসচেতনতার ফল। শিশু টিভি দেখলে একেবারে সামনে চলে যাচ্ছে বা বইটাকে একেবারে সামনে নিয়ে দেখছে। এসব খেয়াল করলেন কিন্তু তারপরও যদি চিকিৎসা না করেন তাহলে বড়দের অসচেতনতার দায়ে দায়ী করা যায়।

বাংলাদেশে শিশুদের চোখের সমস্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেড়েছে কি?

আগের তুলনায় দেশে শিশুদের চশমার ব্যবহার বেড়েছে। অন্যান্য বিষয়ে ভারত, পাকিস্তান, নেপালের সঙ্গে একই রকম মিল রয়েছে।

দেশে শিশুদের চোখের চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে?

আমাদের একটা ন্যাশনাল আই কেয়ার আছে, তারা ন্যাশনাল আই কেয়ার প্ল্যান তৈরি করে। সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চোখের ছানি, গ্লুকোমা বা ডায়াবেটিক রোগীদের দিকে বেশি নজর দেয়া হয়। কিন্তু যার চোখে ছানি পড়ল তার বয়স হয়তো ৬০। ৮০ বছর বাঁচলে তার জীবৎকাল আর ২০ বছর। আর শিশুর যদি চোখে দেখার সমস্যা হয় সে কিন্তু ৮০ বছর ধরে কম দেখবে বা অন্ধ থাকবে। তাই আমার মনে হয় ন্যাশনাল আই কেয়ারে শিশুদের এসব রোগ নিয়ে আরো নজর দেয়ার দরকার আছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫