১৯৭০ সালের আগস্টে ভয়াবহ এক বন্যার শিকার হয় বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)। ওই বন্যার ক্ষত পুরোপুরি শুকানোর আগেই ১২ নভেম্বর উপকূলীয় জেলাগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ংকরী ভোলা সাইক্লোন। আবার এরও ঠিক চার মাসের মাথায় ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন (দমন অভিযান) ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ঘটে যায় ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা। স্বল্প বিরতিতে পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেশের খাদ্যের মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থায়ও বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটায়।
ওই সময় বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া বিদেশীদের অনেকেই দেশে ফিরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, পূর্ব বাংলায় গ্রীষ্মের শেষ দিকে এসে খাদ্য সংকট মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এমনকি কেউ কেউ গণহত্যায় বিপর্যস্ত জনপদে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন।
খাদ্য সংকট সে সময় সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছিল ভোলা সাইক্লোনে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোয়। ক্র্যাকডাউনের পর শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার নেয়। সাইক্লোনবিধ্বস্ত কোনো কোনো এলাকায় জনসংখ্যা ওই সময় আকস্মিকভাবে স্বাভাবিকের দ্বিগুণ হয়ে ওঠারও তথ্য পাওয়া যায়। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সেখানকার তুলনামূলক দুর্গম এলাকার মানুষ বেঁচে ছিল শিকড়-বাকড় খেয়ে। ওই মাসের মাঝামাঝির দিকে মিষ্টি আলুর ফলন পরিস্থিতি কিছুটা প্রশমিত করে। কিন্তু সেখানেও ফলন ছিল স্বাভাবিকের এক-তৃতীয়াংশ। কিছু পরিমাণে ত্রাণ সহায়তা এলেও তা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। জুনের মাঝামাঝি সময় ওই এলাকা থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে খাদ্য প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। যেকোনো সময় দেখা দিতে পারে ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ।
তবে আশঙ্কার দুর্ভিক্ষ শেষ পর্যন্ত দেখা দেয়নি। দুর্গম ওই এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপদ্রব ছিল কম। ফলে সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা অপ্রতুল হলেও তা এক প্রকার চালু রাখা গেছে।
অন্যান্য জেলায়ও পরিস্থিতি খুব একটা ভালো ছিল না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সে সময় উৎপাদন নয়, সরবরাহ ব্যবস্থাই হয়ে পড়েছিল পূর্ব বাংলার খাদ্যশস্য সমস্যার প্রধানতম দিক। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে মোট জেলার সংখ্যা ছিল ১৯। এর মধ্যে খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বা উদ্বৃত্ত ছিল ১২টি জেলা। বাকি সাতটির সবক’টিই ভুগছিল খাদ্য ঘাটতিতে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য জেলাগুলোকে নির্ভর করতে হচ্ছিল অন্য জেলা বা সরকারি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর।
কিন্তু সামরিক জান্তার যুদ্ধকালীন অব্যবস্থাপনা সরকারি সরবরাহ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অকার্যকর করে ফেলেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ওই সময় পূর্ব বাংলার আপামর জনসাধারণের দিন কেটেছে আতঙ্কে। ঘর থেকে বের হওয়া ছিল দুষ্কর। এর মধ্যেও কৃষকরা উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন ঠিকই। আবার চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে কিছু পরিমাণে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যও এসেছে। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল উৎপাদিত খাদ্যশস্য সারা দেশের বাজারে সরবরাহের পুরোপুরি প্রতিকূলে। রেল বা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। নদীকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থাকে সীমিত করে তুলেছিল নৌকার অভাব। ওই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রচুর নৌকা হয় ধ্বংস করেছে, নয় জব্দ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধি দল জুনে পূর্ব বাংলা ঘুরে যায়। সফর শেষে ফিরে গিয়ে তাদের পক্ষ থেকে এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, পূর্ব বাংলার খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধসে পড়েছে। রেল ও মোটর ট্রাফিক ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে (মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে) সংঘাত। নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে নৌকার অভাব। যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আবার এপ্রিলের শুরু থেকে অনেকগুলো পথ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আছে। সিগন্যালিং যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় রেলপথে দিনে চলাচল এখন অনেক সীমিত হয়ে এসেছে। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে রাত্রিকালীন চলাচল। যেসব এলাকায় চলাচল নিরাপদ সেখানেও অনেক সড়ক ও সেতু নষ্ট হয়েছে। আবার খাদ্যবাহী ট্রাকেরও বড় একটি অংশ পাকিস্তানি মিলিটারি নিয়ে নিয়েছে।
ওই সময়কার বিভিন্ন দিনলিপিতে দেখা যায়, মার্চের শেষ দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন ঠিক সে সময় চট্টগ্রাম ও চালনামুখী শস্যবাহী জাহাজগুলোর মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে করাচির দিকে। যুদ্ধে বন্দরের কোনো ক্ষতি না হলেও শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। আবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ কার্যক্রম ঠিক রাখতে গিয়ে বন্দরগুলোর ডকে বেসামরিক পণ্য খালাসের কার্যক্রম কমে আসে। মে মাসের দিকে খাদ্যশস্য আমদানি আবার শুরু হলেও খালাস কার্যক্রম ছিল স্বাভাবিকের অনেক নিচে।
যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের খাদ্য সংকট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘খাদ্য সংকট খাদ্য উৎপাদন ও আমদানির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের এখানে ১৯৬৯ সালের পর থেকেই খাদ্য উৎপাদন কমে আসছিল, যা ১৯৭১ সালে আরো কমে যায়। আবার এক পর্যায়ে আমদানীকৃত খাদ্যবাহী জাহাজও বাংলাদেশে আসা বন্ধ হয়ে পড়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। সে সময় মানুষ প্রাণভয়ে ভীত ছিল। শহর ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল গ্রামে। দেশে রয়ে যাওয়া মানুষজন অর্ধভুক্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছে। আবার যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল, তারাও সেখানে গিয়ে খাবারের কষ্টে দিন কাটিয়েছে।’
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে মাসিক গড় পণ্য খালাসের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার টন। ১৯৭১ সালের মে ও জুন মাসে তা ছিল যথাক্রমে ৪৫ হাজার ও ৩৭ হাজার টন। চালনা বন্দরের গড় ৫৪ হাজার টন থেকে মে ও জুনে তা নেমে আসে প্রায় ১২ হাজার ও ৩১ হাজার টনে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি বন্দরের আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ধারণক্ষমতার শতভাগ। চট্টগ্রামের গুদামগুলোয় খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল সক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি। এমনকি পরিত্যক্ত অফিস ভবনেও সে সময় খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখা হচ্ছিল।
যুদ্ধের প্রথম দুই মাসে কিছু এলাকায় সরকারি মজুদ থেকে শস্য উত্তোলন ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সারা দেশের বাকি মজুদের ভৌগোলিক বণ্টন ছিল পুরোপুরি অস্বাভাবিক। ১ জুনের মধ্যেই দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ (শস্যাগার, বন্দর, জাহাজ ও ট্রানজিট) নেমে আসে সাড়ে চার লাখ টনে। যেখানে ১ মার্চ এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৮০ হাজার টন।
আবার ব্যক্তি পর্যায়ের মজুদও ওই সময় নেমে এসেছিল অনেক নিচে। মার্চের শুরুতেই কৃষকের গোলায় ধানের পরিমাণ ছিল অন্যান্য বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক কম। সর্বশেষ আমন মৌসুমে ধান উৎপাদন হয়েছিল অনেক কম। বোরো ধানের উৎপাদনও এ পরিস্থিতিতে তেমন একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি। আবার পাকিস্তানি বাহিনী সে সময় একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। কৃষকের গোলায় ধানের মজুদ কমে আসার পেছনে এ বিষয়টিও বড় ভূমিকা রেখেছে। সিআইএর কিছুদিন আগে উন্মুক্ত করা গোপন প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর কৃষক পর্যায়ে খাদ্যশস্যের মজুদ কমে যাওয়ার পেছনে পাকিস্তানি বাহিনীর গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগকে দায়ী করা হয়েছে।