বিস্ফোরণ আতঙ্ক পোশাক শিল্পে

নিয়ন্ত্রণে উদ্যোক্তা এবং কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যথাযথ ব্যবস্থা নিক

প্রকাশ: মার্চ ২৩, ২০২৩

সম্প্রতি কয়েকটি স্থানে সংঘটিত বিস্ফোরণে বেশকিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবনে ব্যবহৃত এয়ারকন্ডিশনার ও গ্যাস লাইনে এ বিস্ফোরণ ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেহেতু পোশাক শিল্প-কারখানাগুলোয় এয়ারকন্ডিশনার ও গ্যাসের ব্যবহার রয়েছে, তাই বিষয়টি নিয়ে উদ্যোক্তারা আতঙ্কিত। কারখানার বয়লার বিস্ফোরণেও বিভিন্ন সময়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পোশাক শিল্প-কারখানায় অধিকসংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত থাকায় এ ধরনের দুর্ঘটনায় তাদের হতাহতের ঝুঁকি বেশি। রফতানি আয়ের বড় অংশই পোশাক খাত থেকে অর্জিত হয়। সংগত কারণেই এখানে কর্মপরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিদুর্ঘটনা নিরোধ ব্যবস্থা টেকসই হওয়া দরকার। এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ মনোভঙ্গি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। বিষয়টি নিয়ে সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। আর শুধু পোশাক কারখানা নয়, সব জায়গায়ই বিস্ফোরণ ও অগ্নিদুর্ঘটনার বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। বিস্ফোরণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে মালিকদেরই প্রথম এগিয়ে আসতে হবে। কারখানা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরবর্তী ধাপে শিল্প-কারখানাগুলো যথাযথ নিয়ম পরিপালন করছে কিনা সেটি তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সক্রিয়তা প্রয়োজন। 

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানাগুলোয় প্রতি বছর ক্রমেই বাড়ছে অগ্নিদুর্ঘটনা। একই সঙ্গে বড় হচ্ছে আর্থিক ক্ষতির অংকটাও। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২ সালে শুধু তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৮৪টি। এর মধ্যে রফতানিমুখী কারখানায় ২৪১ ও স্থানীয় কারখানায় ১৪৩ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর অধিকাংশই বিস্ফোরণের কারণে অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। কারখানায় বিস্ফোরণের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। বয়লার, জমে থাকা গ্যাস, সিলিন্ডার, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ইত্যাদি থেকেই বিস্ফোরণ ঘটছে। কারখানা কমপ্লায়েন্স মেনে পরিচালিত হলে এবং সম্ভাব্য বিস্ফোরণের জন্য দায়ী উপাদানগুলো নিয়মিত তদারকি করা হলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক কারখানার বয়লার চলছে কোনো রকম সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই। ফলে সেগুলো নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে। আবার নিবন্ধন করলেও অনেক বয়লারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করে সেগুলো নবায়ন করা হচ্ছে না নিয়মিতভাবে। আবার কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্স মেনে পরিচালিত হচ্ছে না। গাফিলতি রয়েছে পরিদর্শনের সঙ্গে জড়িত কার্যালয়েরও। কারখানা পরিদর্শনসহ বয়লার ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু কারখানা তো বটে তদারককারী সংস্থাও সঠিকভাবে এগুলো দেখছে না। দুঃখজনকভাবে পরিদর্শনের কাজটিও যথাযথভাবে করা হচ্ছে না। কারখানার কমপ্লায়েন্স ও বয়লার ব্যবহারকারী কারখানার সংখ্যা অনেক বেশি হলেও পরিদর্শকের সংখ্যা অপ্রতুল। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থাও নেয়া সম্ভব হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে শিল্প-কারখানায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন কারখানায় দুর্ঘটনার বিষয়গুলো দেখভাল করার কথা শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বা ডাইফির। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কমছে না। এক্ষেত্রে তদারকি সংস্থার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। 

শিল্প-কারখানা বিস্ফোরণে অন্যতম অনুষঙ্গ হলো বয়লার। নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলেও অনেক বয়লার চলছে কোনো রকম সরকারি নিবন্ধন ছাড়াই। ফলে সেগুলো নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এটা একটা কাঠামোগত দুর্বলতা। আবার নিবন্ধন করলেও অনেক বয়লারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করে সেগুলো নবায়ন করা হচ্ছে না নিয়মিতভাবে। রয়ে যাচ্ছে নানা ত্রুটি। শুধু স্থাপন করলে হয় না, বয়লার সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণও একটা বড় ইস্যু। অভিযোগ মিলছে, অনেক সময় সেগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। গাফিলতি রয়েছে বয়লার পরিদর্শন কার্যালয়েরও। এ কার্যালয়ের কাজ নিবন্ধন দেয়ার পাশাপাশি ঠিকমতো বয়লার বসানো হয়েছে কিনা, কী অবস্থায় আছে সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেয়া। অথচ দুঃখজনকভাবে পরিদর্শনের কাজটি যথাযথভাবে করা হচ্ছে না। বয়লার ব্যবহারকারী কারখানার সংখ্যা অনেক বেশি হলেও পরিদর্শকের সংখ্যা খুব অপ্রতুল। ফলে বেশির ভাগ কারখানার বয়লার চলছে পরিদর্শন ছাড়াই। তার মধ্যে আবার যুগোপযোগী আইন নেই। এখতিয়ার সীমিত হওয়ায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থাও নেয়া সম্ভব হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে বয়লার বিস্ফোরণের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে শিল্প খাতে।

শিল্প-কারখানায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি থাকায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে জোর দেয়া হয়। নিবন্ধন থেকে পরিচালনা সব ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা হয় রাষ্ট্রীয় নজরদারি। কোনো বয়লার নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে কিনা, মান ঠিক আছে কিনা, মেয়াদ আছে কিনা, যান্ত্রিক ও ভৌত ত্রুটি আছে কিনা, কীভাবে চালানো হচ্ছে, ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে কিনা, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে কিনা—সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা হয়। কারখানার কমপ্লায়েন্স পরিপালনে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্বলতা যেন না থাকে, সেজন্য বিদ্যমান আইনগুলো পর্যালোচনা করা হয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর। সময়োপযোগী করতে আইনে আনা হয় প্রয়োজনীয় সংস্কার। বলতে গেলে যুগোপযোগী আইন, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নজরদারি এবং কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতায় উন্নত দেশগুলোয় কারখানায় বিস্ফোরণ প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশেও বয়লার আইন ১৯২৩ রহিত করে নতুন আইন পাস করা হয়েছে ২০২২ সালে। কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তায় কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মালিকপক্ষ সেটি মানতে আগ্রহী নয়, সরকারি কর্তৃপক্ষও সেটি পরিপালনে জোরদার ব্যবস্থা নেয় না। 

প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেয়া হলে বহুলাংশেই দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ব্যাপারে বিশ্বস্বীকৃত নীতি হলো ‘সেফটি ফার্স্ট’ বা নিরাপত্তাই প্রথম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপত্তামূলক আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে শিল্প দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এজন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধান থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয় না। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর আওতায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধানের যে নিয়ম রয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা, ২০১৩ সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে পরিস্থিতির নিশ্চিতভাবেই উন্নতি সম্ভব। এক্ষেত্রে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব কারখানা মালিক ও সরকারের। কারখানায় ব্যবহৃত বয়লার ও গ্যাসের লাইন থেকেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে এ ঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে। তাই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে কারখানা ও কর্মস্থলে এসি, বয়লার ও গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান দিয়ে পরীক্ষা করানো, গ্যাসের চাপ সঠিক মাত্রায় রাখার ব্যবস্থা করা, মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার পরিবর্তন করা, কারখানায় ব্যবহৃত সব ধরনের বয়লার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অপারেটর দিয়ে পরিচালনা প্রয়োজন। 

বিস্ফোরণ ঘটা কোনো দৈব বা প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। এটি সম্পূর্ণ কারখানার ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার ফল। সঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই বিস্ফোরণ ঘটা ও অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ অনেকাংশে সম্ভব। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে নিয়মিত কারখানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করা। সঠিক পরিবেশবান্ধব ও সবার জন্য নিরাপদ কারখানা ব্যবস্থাপনা বিস্ফোরণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে কারখানার মালিকের যেমন, তেমনি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সতর্কতা ও সক্রিয়তার বিকল্প নেই।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫