এমন বৃষ্টির দিন, গন্তব্যও ডুবে গেলো শেষে,
সমুদ্র হারিয়ে যায়, নাবিককে পৌঁছে দিতে এসে।
— ইমতিয়াজ মাহমুদ
প্রতি মুহূর্ত অতীত হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতির স্তরে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন ধারণা। অনুভূতির অনুরণনে যে অনুকম্প বোধ হচ্ছে তার গতিপথ কোনদিকে? সদ্য ঘটে যাওয়া কোনো এক নির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয়ের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই টের পাওয়া যায় ব্যাপারটা। সার্বিক থেকে বিশেষ কিংবা বিশেষ থেকে সার্বিক—কোন পদ্ধতিতে চিন্তা এগোবে সে ব্যাপারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটা অচেতন যাত্রা শুরু করে মস্তিষ্ক। আমাদের স্মৃতি, লিখিত ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ আর ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ঘটনা বা বিষয়ের সম্পর্ক যখন সরলরৈখিক না, তখন চিন্তা পদ্ধতি সরলরৈখিকভাবে চলবে না এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বায়নের এ জমানায় মানুষের পরিচয়ের পরিধি যখন বদলে যাচ্ছে, তখন আত্মমগ্নতার ধরনেও বদল ঘটবে সেটাই তো অনুমেয়। ‘জিরো ক্যালরি’ এমন এক শব্দ যুগল যার ডিনোটেশন (বাচ্যার্থ) সহজে অনুধাবন করা গেলেও কোনোটেশনের (লক্ষ্যার্থ) ব্যাপকতা আমাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে ভোক্তা হিসেবে আমাদের অবস্থান, সমাজের বিভিন্ন স্তরে ‘জিরো ক্যালরি’র চরিত্র, আর এ ব্যবস্থার রাজনৈতিক পরিসরে ব্যক্তির চরিত্র—অন্তত এ কয়েকটা ব্যাপার সার্বিকভাবে মাথায় রেখেই এগোতে হচ্ছে।
সময়ের পরিক্রমায় দৃশ্যশিল্পের চৌহদ্দিতে যেসব পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার ব্যঞ্জনা নানাবিধ। শিল্পীর চিন্তাধারা তো বটেই, শিল্পের ভাষা, শিল্পকর্মের মাধ্যম-উপকরণ ও উপস্থাপনরীতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে শিল্পপ্রদর্শনীর চিরায়ত ভঙ্গিমা। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে জাতি-রাষ্ট্রের নামে পৃথিবীর ভূখণ্ড ভাগ করে নেয়া কর্তৃত্বশীল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শিল্পীর আকাঙ্ক্ষা ও সৃষ্টির সঙ্গে বৃহদায়তন সমাজের সম্পর্কও বদলে গেছে ব্যাপকভাবে। ক্ষমতা কাঠামো তার নিপীড়নের কৌশল হিসেবে অনবরত আদর্শ বা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে। শিল্পীরা কখনো কখনো এ আদর্শের ধারণাগুলো গ্রহণ করেন, আবার কখনো বিপরীত অবস্থানে গিয়ে আদর্শের দৈন্যকে বিভিন্নভাবে তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
সম্প্রতি ‘জিরো ক্যালরি’
শিরোনামে হাজারীবাগের ভাস্কর্মী স্টুডিওতে শুরু হওয়া দাগী আর্ট গ্যারেজের (ঢাকাভিত্তিক দৃশ্যশিল্প সংগঠন) প্রদর্শনী এ রকম কিছু ভাবনার রসদ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। প্রচলিত প্রদর্শনীর ধারা থেকে এ প্রদর্শনীর ধরন বেশ আলাদা। শিল্পের মাধ্যম ও উপকরণের জন্যই শুধু নয়, প্রদর্শনীর স্থান এবং শিল্পীদের বক্তব্য উপস্থাপনের ধরনেও রয়েছে ভিন্নতা।
রূপক ব্যবহারের চিরায়ত ভঙ্গিমার মধ্যেও এখানে রয়েছে বাড়তি আরো কিছু, যা তুলে ধরে এ সময় ও আমাদের মননের দৃশ্যপট। ভাবতে বাধ্য করে আমাদের ছুটে চলার গতিপথ।
সানজিদ মাহমুদের ‘স্টোরি অব দ্য ককরোচ’
শিরোনামের কাজে দেখা যায় লবণের মধ্যে প্লাস্টিকের খেলনা, কাচের শিশি জাতীয় কিছু বস্তু, চাবি ইত্যাদি এলোমেলো পড়ে আছে। লবণের অধুনা ভাষায় কি সানজিদ মাহমুদ এ সময়ের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে চাইছেন? আবার তার ৪০x১০ ফিটের একটা নির্বস্তক পেইন্টিংয়ের শিরোনাম ৪০x১০ কিংবা মাটিতে একটা সবুজাভ নীল রঙের কাঠের ফ্রেমের মধ্যে নরম প্লাস্টিকের গা বেয়ে আলকাতরা ঝরে পড়া কাজের শিরোনাম ‘সিটি উইন্ডো’। স্মৃতিকাতরতার বিভোরে থাকা এ রূপকের ব্যবহার রাসেল চৌধুরীর ‘ইগারনেস’
শিরোনামের কাজেও দেখা যায়। পুরনো অনেক নষ্ট রঙিন ছবি পাশাপাশি রাখা, যেগুলোর কোনো ক্রম ধরা যায় না। সময়কাল আন্দাজ করা গেলেও নির্দিষ্ট করে চেনা যায় না ছবির ব্যক্তিদের। তাদের জাতি-বৈশিষ্ট্যের ধরন আঁচ করা যায় কিছুটা, কিন্তু স্থান সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু তার ‘মার্জিনাল’
শিরোনামে করা কাজের বিষয়বস্তু কি শুধুই স্মৃতির বিভোরে আটকে থাকা অবস্থানকে উপস্থাপন করে? না তা করে না, বরং অ্যাকুয়ারিয়ামের কাচের বাক্সে গাছের গুঁড়ি, নুড়ি-পাথর-বালিসহ নানা উপাদানের সমারোহ ছয়টি লোহার দণ্ডের ওপর ভর দিয়ে রাখা এবং সেগুলোর ছয়টি পায়ে পরানো নির্মাণশ্রমিকদের জুতার দৃশ্য সমাজের গ্লানি বয়ে চলা এক শ্রেণীকে নির্দেশ করতে চায়। দেখাতে চায় প্রগতির গায়ে কলঙ্কের দাগ। সৈয়দ তারেক রহমানের ‘ইট (খাওয়া)’ শিরোনামের কাজের উপস্থাপনার ভঙ্গি বেশ জটিল। সাদা রঙের দরজা, দরজার ওপরের অংশে গ্লাসে চোখ রাখলেই দেখা যায় দূরে সাদাকালো একটা ভিডিও চলছে, যেখানে একই ফ্রেমের মধ্যে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর—কুকুর, মুরগি ইত্যাদি খাবার খাওয়ার দৃশ্য। সবাই গোগ্রাসে খাচ্ছে। প্রাণিজ প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠতে পারল কি মানুষ? নাকি সেই স্তরেই আছে, শুধু গায়ে লেগেছে সভ্যতার তকমা?
খুঁড়ে রাখা গর্তের মধ্যে চিরচেনা লোকশিল্পের দুলদুল ঘোড়া, কাঠের বেজমেন্টের ওপর আরো কিছু লোকশিল্পের মোটিফ একটার ওপর আরেকটা গাদাগাদি করে রাখা। পাশেই কাচের ফ্রেমে রাখা আছে সেলাই করা গাছের বাকল, যদিও কোনো গাছের তা চেনা যাচ্ছে না। একটু দূরে বিভিন্ন আকৃতির কয়েকটা ক্যানভাস ঝুলছে দেয়ালে, কিন্তু সেগুলো পরিচিত ক্যানভাস পেইন্টিংয়ের মতো না। সেখানে ক্যানভাসের সঙ্গে ট্যাগ ঝুলছে। একটা ক্যানভাস পলিথিনবন্দি অবস্থায়। ‘ইন দিস কমিউট অব কনটেম্পোরারি টাইম ১, ২, ৩’
শিরোনামে ইমরান সোহেল লোকশিল্পের প্রতীকগুলোকে যেভাবে হাজির করছেন সেটা কি আমাদের শিল্পের ভবিতব্য নাকি বর্তমান অবস্থা? স্পষ্ট হওয়া মুশকিল, কিন্তু ভাবনার স্তরে আমাদের থাকা প্রশ্নগুলোকে উস্কে দেয়। রুপম রায়ের ‘আই লাভ অ্যানিমেল’
শিরোনামের কাজটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আবেদন তৈরি করে। সিংহাসনের চার পায়ে আটকানো পশুর চামড়ার স্তর দৃশ্যগত সৌন্দর্যের বাইরে গিয়ে বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজে চলমান নৃশংসতার প্রতীক হয়ে ওঠে। ধীমান সরকারের ‘বাঙ্গু মাইন্ড’
শিরোনামের কাজে দেখা যায় একটা ভাঙা খাট ঝুলছে দেয়ালের কাছাকাছি, আর একটা বালিশ সেঁটে আছে দেয়ালে। দেয়ালের নিচের দিকে লাল রঙের ওপর লেখা ‘গতকাল রাইতে অসুর বানিপাল খাট থেকে পইড়া গেছলেন।’
এটা কি শুধুই পরাবাস্তব কল্পনা? নাকি দেয়ালে লেখা টেক্সট ক্ষমতাসীনদের মকারি করে? নাকি খুবই লিরিক্যাল, বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের উদ্ভট মানসিক অবস্থার চিহ্নায়ন? ‘ভিজুয়াল ইকুয়েশন’
শিরোনামে শিল্পী সনদ বিশ্বাসের ভিডিওটিও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। স্থান, কাল চেনা যায় বরং ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখা যায় কাজটিতে। প্রদর্শনীর মূল স্পেসের বাইরে থাকার ফলে সেটি ভিন্ন দ্যোতনা তৈরি করে।
সাতজন শিল্পী একই স্পেসে নিজস্ব ভাবনা নানাবিধ মাধ্যম ও রীতিতে ভিন্নভাবে তাদের শিল্পকর্ম উপস্থাপন করলেও অনায়াসেই একটার সঙ্গে আরেকটার যোগাযোগ রচনা করা যায়। খুব দূরবর্তী মনে হয় না। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে গত ৮-১০ বছর কিউরেটরের অন্তর্ভুক্তি খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠলেও বর্তমান প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে ‘দাগী আর্ট গ্যারেজ’-এর শিল্পীরা সে পথে হাঁটেননি। তাদের এ সচেতন অবস্থান কি এ প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করল? যা-ই হোক প্রচলিত নান্দনিক অভিরুচি তৈরির বাইরে গিয়ে শিল্পীদের এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, দর্শক হিসেবে আমাদেরকে প্রশ্ন ছুড়ে দেবে, সমাজবাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, সেটাই প্রত্যাশা।
শাওন চিশতী: দৃশ্যশিল্পী