নবজাতকের জন্ডিস

নবজাতকের ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস স্বাভাবিক ব্যাপার

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩

শর্মিলা সিনড্রেলা

জন্ডিস আক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে বেশ ভুগেছিলেন মাকসুদা আর সায়েম দম্পতি। এমনকি নবজাতককে দিতে হয়েছিল ফটোথেরাপিও। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সেসব দিন পেরিয়েছে অল্প সময়েই। কিন্তু সদ্য সিজার হওয়া মা সন্তানকে নিয়ে যে সংগ্রামটা করছিলেন তা এখনো মনে করতে পারেন মাকসুদা। তিনি বলেন, ‘‌ওই সময়ে সন্তান হলুদ হয়ে যাচ্ছিল। বুঝতে পেরে দেরি না করে চিকিৎসককে দেখাই। এমন পর্যায়ে দ্রুত চিকিৎসা নেয়ায় সুস্থ হয় সন্তান।’

জন্ডিস আক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে ভোগেন অনেকে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশুর জন্মকালীন জন্ডিস ততটা ভয়ংকর নয়। সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুরোগ বিভাগের সাবেক ডিন প্রফেসর সুরাইয়া বেগম বলেন, ‌অনেক শিশুই জন্মকালীন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস। আর কিছু হয় প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস। শিশুর জন্মকালে ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস হলে অবশ্যই তার কারণ বের করে চিকিৎসা করতে হয়। ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস টার্ম বেবি ও প্রিটার্ম বেবির ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম হয়। টার্ম বেবি বা গর্ভকাল পূর্ণ করে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ হয়ে থাকে আর প্রিটার্ম বেবি অর্থাৎ সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশুদের ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস হয়ে থাকে।

ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয়ে টার্ম বেবির ক্ষেত্রে ১০ দিন পর্যন্ত থাকে আর প্রিটার্ম বেবিদের ক্ষেত্রে ১৫ দিন থাকে। এক্ষেত্রে বিলিরুবিনটাও তেমন বাড়ে না, টার্ম বেবিদের ক্ষেত্রে ১২ এবং প্রিটার্ম বেবিদের ক্ষেত্রেও ১৫ পর্যন্ত বাড়ে এবং ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। অন্যদিকে প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস সাধারণত ডে ওয়ান মানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যায়। সেটা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে, শিশু একদম হলুদ হয়ে যায়। অনেক সময় বিলিরুবিন অনেক বেশি যেমন ২০-২৫ পর্যন্ত হয়ে যায়। আর প্রতিদিন যদি রেট অব রাইজ ৫ মিলিগ্রামের বেশি বাড়তে থাকে তখন আমরা বলি যে এটা প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস। সেক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন করতে হয়।

তবে ফিজিওলজিক্যাল ও প্যাথলজিক্যাল জন্ডিসের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের কারণ মূলত শরীরে বিলিরুবিন বেড়ে যাওয়া। বিলিরুবিন আবার দুই ধরনের। আনকনজুগেটেড আর কনজুগেটেড। কনজুগেটেড বিলিরুবিন মল বা প্রস্রাবের সঙ্গে চলে যায় কিন্তু আনকনজুগেটেড বিলিরুবিন যায় না। আনকজুগেটেড থেকে বিলিরুবিন কনজুগেটেড হতে একটা এনজাইম লাগে। সেটা নবজাতকের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ম্যাচিউর হয় না। তাতেই আনকনজুগেটেড বিলিরুবিন কনজুগেটেড হতে একটু সময় লাগে। সেই সময়েই বিলিরুবিনটা বেড়ে যায় এবং নবজাতক জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে ৭-১০ দিনেই সেই এনজাইমের ম্যাচিউরেশন হয়ে যায় এবং জন্ডিস কমে যায়।

নবজাতকের ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস কোনো রোগ নয়। কিন্তু প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস একটা রোগ। সেটা হয় লিভারের কোনো সমস্যা যেমন হেপাটাইটিস, ইনফেকশন, ব্লাডে ইনফেকশন, টর্চ ইনফেকশন এসব থাকলে। আরবিসি ভেঙে যাওয়ার কারণেই কিন্তু বিলিরুবিন তৈরি হয়। বেশি বেশি আরবিসি ভেঙে গেলে বিলিরুবিন অনেক তৈরি হয়। যদি মায়ের ব্লাড গ্রুপ আরএইচ নেগেটিভ থাকে এবং সন্তানের আরএইচ পজিটিভ হয় তাহলে আরবিসি ভেঙে যায় তখন বিলিরুবিনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন হয়।

তবে সুরাইয়া বেগম আশ্বস্ত করে বলেন, ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস খুবই ন্যাচারাল। তবে যাতে খুব বেশি বেড়ে না যায় সেক্ষেত্রে আমরা কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। যেমন শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ দিতে হবে যেন শরীরের বিলিরুবিন প্রস্রাব ও মলের সঙ্গে বের হয়ে যেতে পারে। শিশুকে রোদে দিলে শিশুর জন্ডিস হলেও খুব বেশি বেড়ে যাবে না। এভাবে করে শিশুর জন্ডিস যেন ফটোথেরাপি দেয়ার মতো বেড়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে পারি।  

ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস কখনই শিশুর জন্য জীবননাশী হুমকি তৈরি করে না। তবে প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। হরমোনের সমস্যা বা হাইপোথাইরয়েডের কারণে এটা হতে পারে। প্যাথলজিক্যাল জন্ডিসে সময়মতো চিকিৎসা না দিলে বিলিরুবিন যদি অনেক বেড়ে যায় তখন বিলিরুবিনগুলো ব্রেইনে জমা হয়, ফলে খিঁচুনি হতে পারে, সেরিব্রাল পালসি হতে পারে, মানসিক অক্ষমতা বা শারীরিক অক্ষমতা হতে পারে। যেহেতু এই রোগ প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই। তাই একেবারে কারণ বের করে চিকিৎসায় যেতে হয়।   

ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসে কী চিকিৎসা দেয়া হবে তা নির্ভর করবে বিলিরুবিনের ওপর। পাশাপাশি শিশু টার্ম নাকি প্রিটার্ম, তার বয়স কত—সেসব বিবেচনা করে চিকিৎসা দেয়া হয় বলে জানান এই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস টার্ম শিশুদের ১২-এর বেশি উঠলে এবং প্রিটার্ম শিশুদের আরো আগের লেভেলেই ফটোথেরাপি দিয়ে থাকি। ফটোথেরাপি দিলে বেশির ভাগ শিশুই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের ক্ষেত্রে আর কোনো চিকিৎসার দরকার হয় না। কিন্তু প্যাথলজিক্যাল জন্ডিসে যখন বিলিরুবিন অনেক বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে আমাদের এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন বা ব্লাড চেঞ্জ করে বিলিরুবিনের মাত্রা কমিয়ে আনতে হয়।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫