শিল্পী মানেই জীবনবোধে স্বাতন্ত্র্য। চিন্তায় বৈচিত্র্য। তার সৃষ্টিশীলতায় আকর্ষিত হয় সৃষ্টিশীল মানুষ। বন্ধুত্ব ও নবিশি পর্বের গল্পটি ক্রমে পরিণত হয় প্রেমে। এ ধরনের প্রেম বড় অদ্ভুত। দুটি সৃষ্টিশীল মন একত্রিত হতে পারা যেকোনো যুগ ও শিল্পের জন্য আশীর্বাদ। তারা পরস্পরকে প্রভাবিত করেন। সহযোগিতা করেন পরস্পরের কাজে। ফলে জন্ম নেয় একেকটা মাস্টারপিস। তবে এ ধরনের সম্পর্ক স্থিতিশীল হয় না। অনেকের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
পাবলো পিকাসো ও ডোরা মার
নারীদের প্রতি পিকাসোর আগ্রহ মন্দ ছিল না। প্রমাণ দেখা যায় তার প্রেমিকার সংখ্যাতেই। অন্তত সাত নারীর সঙ্গে তিনি উদযাপন করেছেন জীবন। তবে তাদের মধ্যে ডোরা মারের প্রভাব ছিল অন্য মাত্রার। ফটোগ্রাফার, পেইন্টার ও কবি ডোরা মারের মূল নাম থিওডোরা মারকোভিচ। পিকাসোর সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ হয়, তখন তার বয়স ২৮। সে ১৯৩৫ সালের কথা। পিকাসোর ততদিনে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বয়সেও তার চেয়ে ২৮ বছর বড়। ডোরা সবসময়ই মনে করতেন পিকাসো তার ওস্তাদ ও ভালোবাসা।
পিকাসো স্ত্রী ওলগার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন তখন। মানসিকভাবে ভঙ্গুর ছিলেন। ডোরা তার জন্য নতুন ঠিকানা হয়ে দাঁড়ালেন। তার অনুপ্রেরণা থেকেই জন্ম নিতে থাকল একের পর এক মাস্টারপিস। স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৭ সালে পিকাসো যখন ‘গোয়ের্নিকা’
নিয়ে কাজ করছেন, ডোরা ছিলেন পাশে। ক্যামেরাবন্দি করেছেন বিভিন্ন পর্যায়। গোয়ের্নিকা ছিল একই সাথে নিউক্ল্যাসিসিজম, সুররিয়ালিজম ও কিউবিজমের সমষ্টি। রয়েছে হতাশা, বেদনা, আতঙ্ক ও পঙ্গুত্ব। ডোরাও ফটোগ্রাফির কথা ভুলে পিকাসোর সঙ্গে পেইন্টিং শুরু করেন। পিকাসোর বাইরেও নিজের স্বাতন্ত্র্য চিহ্ন রাখেন চিত্রকলায়। তার পরও দীর্ঘ হতে পারেনি সম্পর্ক। প্রায় এক দশকের যৌথ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৩ সালে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পিকাসোর সঙ্গে ছিলেন তিনি। ডোরাকে পিকাসো ফুটিয়ে তুলেছেন ‘পোর্ট্রেট অব ডোরা মার’,
‘ডোরা অ্যান্ড দ্য মিনোটর’
ও ‘দ্য উইপিং উইমেন’
চিত্রকর্মে।
সালভাদর দালি ও গালা
রক্ত ছাড়া যেমন শরীর নেই, গালা ছাড়া তেমন দালি নেই। ৫৩ বছর একসঙ্গে ছিলেন সালভাদর দালি ও গালা। দুজনেই পরাবাস্তব আর্টের পথিকৃৎ। ১৯২৯ সালের গ্রীষ্মে প্রথম দেখা করেন তারা। গালা আগে বিবাহিত ছিলেন পল এলুয়ারের। কন্যাসন্তানও রয়েছে তখন। কিন্তু দালির সঙ্গে পরিচিতি সবকিছু বদলে দিল মুহূর্তেই। ভালোবাসার জন্য গালা তার স্বামীকে ত্যাগ করেন। দালি খুঁজে পেলেন তার সৃষ্টিকর্মের অনুপ্রেরণা। প্রকৃতপক্ষে গালা যেন দালির জীবনে আর্ট সৃষ্টির আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন।
ক্যাথলিক বিধান মেনে তাদের বিয়ে হয় ১৯৫৮ সালে। যদিও ১৯২৯ সাল থেকেই তারা আর্টের ইতিহাসে কিংবদন্তি জুটি হিসেবে পরিগণিত। তাদের সম্পর্কও ছিল স্থিতিশীল। কেউ কারো ভেতর অবিশ্বাস জন্ম দেননি। তার পরও বিয়েটি ছিল অস্বাভাবিক। দালির দাবি অনুসারে, তাদের ভালোবাসা ছিল প্লেটোনিক। টানাপড়েন যে ছিল না, তা না। তবে দালি গালাকে সুখী রাখতে চাইতেন। গালা অনুপ্রেরণা দিতেন তাকে। তার ছাপও দেখা যায় বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মে। ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন গালা। বিচ্ছেদ দীর্ঘ হয়নি। তার মাত্র সাত বছর পরই ইহজগৎ ত্যাগ করেন দালি।
দিয়েগো রিভেরা ও ফ্রিদা কাহলো
শান্তি আর অশান্তি পাশাপাশি থাকতে পারে? স্বস্তি ও অস্বস্তি? উত্তর রয়েছে দিয়েগো রিভেরা ও ফ্রিদা কাহলোর জীবনে। আর্টের জগতে সবচেয়ে অদ্ভুত জুটি ফ্রিদা ও দিয়েগো। ফ্রিদার জীবন নাটকীয়। শৈশবের পোলিও ও কৈশোরে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার ক্ষত তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। দিয়েগো প্রতিষ্ঠিত ম্যুরালিস্ট। কমিউনিস্ট রাজনীতির সূত্র ধরে দুজনের জানাশোনা। মেক্সিকোর সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশবিরোধিতা তাদের দাঁড় করিয়েছিল একই পাটাতনে। ১৯২৭ সালে আবদ্ধ হন প্রেমে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ফের বিয়ে করেন দুজন। বয়সে তো বটেই, অন্য পার্থক্যও ছিল। রিভেরার ম্যুরালে ক্যানভাস সারা দেয়াল, ফ্রিদার পেইন্টিংয়ে ক্যানভাস দুই ফুটের কম। স্থূল স্বাস্থ্যের রিভেরা উচ্চতায় ছয় ফুট ও ওজনে ৩০০ পাউন্ড। অন্যদিকে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি ফ্রিদার ওজন ১০০ পাউন্ড। ফ্রিদার মা প্রায়ই মজা করে বলতেন ‘হাতি ও ঘুঘুর সংসার’। শুরুটা ভালো ছিল তাদের। দুজন দুজনকে তীব্রভাবেই প্রভাবিত করেছেন আর্টে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করেন রিভেরা। ফ্রিদা থাকা অবস্থায়ই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ক্রিস্টিনার সঙ্গে। ঘটনাটি তাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। সে সময় ফ্রিদার পেইন্টিংজুড়ে ছিল দিয়োগার ছাপ।
ফ্রিদা ও রিভেরার সম্পর্কের অবনতি ঘটলে ১৯৩৯ সালে ডিভোর্স হয়। ঠিক দুই বছর পর পুনরায় বিয়ে করেন। তাদের সম্পর্ক ছিল জটিল। কেউ কাউকে নিয়েও থাকতে পারছেন না আবার কেউ কাউকে ছাড়াও থাকতে পারছেন না। যদিও ফ্রিদা অল্প সময়ের জন্য লিয়ন ট্রটস্কির সঙ্গে সম্পর্কে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিয়েগো ছিলেন তার সবকিছু। ১৯৫৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন ফ্রিদা। বর্তমানে ফ্রিদা কাহলো ও দিয়েগো রিভেরা মেক্সিকান রেনেসাঁর পথিকৃৎ হিসেবে পরিগণিত। তার মৃত্যুর পর রিভেরা তুলে ধরেছেন ফ্রিদার প্রতি তার ভালোবাসার কথা।
হ্যান্স আর্প ও সোফি
১৯১৫ সালে হ্যান্স আর্পের সঙ্গে জুরিখে সাক্ষাৎ করেন সোফি। আর্পের সৃষ্টিকর্মের প্রদর্শনী চলছিল সেখানে। তবে সম্পর্কের সূত্রপাত মূলত একসঙ্গে কাজের সুবাদে। পরবর্তী সময়ে যা পরিণত হয় ভালোবাসায়। তাদের আর্টওয়ার্ক প্রকাশিত হতে থাকে কখনো একক আবার কখনো যৌথভাবে। আর্পই ম্যাক্স আর্নস্ট, হুগো বল ও ত্রিস্তান জারার সাথে মিলে শুরু করেন দাদা মুভমেন্ট। শিল্পকলার ইতিহাসে দাদাবাদ নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
আর্প ও সোফি দুজনেই পেশাগতভাবে প্যারিসে সফল ছিলেন। দুজনের জীবনজুড়েই পরাবাস্তবতা। সোফি কাজ করতেন ইনটেরিয়র ডিজাইন ও সেট নিয়ে। জ্যামিতিক কাঠামো তার চিন্তাকে প্রকাশের প্রধান অনুষঙ্গ। প্রকাশিত হয়েছে কবিতা, ম্যাগাজিন ও অন্যান্য মাধ্যমেও। ১৯২৬ সালে তারা স্ট্রাসবার্গে থিতু হন। স্পষ্ট করে বলতে গেলে স্ট্রাসবার্গ ও প্যারিসে সময় ভাগ করেই বসবাস করতে হতো তাদের। কারণ সোফির পেশাগত দায়িত্বের কেন্দ্র ছিল প্যারিসে। যা হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর আগ্রাসনে তাদের পালিয়ে যেতে হয় প্যারিস থেকে। তবে জীবন সোফিকে পালাতে দেয়নি। কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় ১৯৪৩ সালে ইহজীবন ত্যাগ করেন। এখনো আধুনিক আর্টে সোফিকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবেই স্থান দেয়া হয়।
রঁদ্যা ও কামিল ক্লদেল
কামিল যখন রঁদ্যার সঙ্গে দেখা করলেন, তখন তার বয়স সবে ১৯। দুজনের বয়সের ব্যবধান ২৪ বছর। কামিল খুব দ্রুতই তার অনুসারীতে পরিণত হলেন। আলাদা করে তুললেন নিজের অবস্থান। পরিচিতি পরিণত হলো প্রেমে। কামিলের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায়ই রঁদ্যা তৈরি করেন কয়েকটি মাস্টারপিস। তাদের মধ্যে ‘দ্য বার্গার্স অব কালাইস’
ও ‘দ্য গেট অব হেল’
অন্যতম। কামিল নিজেও যে কত বড় আর্টিস্ট ছিলেন, তার প্রমাণ ‘দ্য ম্যাচিউর এইজ’
ও ‘শকুন্তলা’।
পৃথিবীর অন্যতম মহান ভাস্কর রঁদ্যা। বিশ শতকের বিমূর্ত ও নিরীক্ষামূলক আর্টের রূপ দিয়েছেন তিনি, কামিলকে তিনি বুঝলেন না। ক্রমে জটিল হয়ে উঠল যেন সম্পর্ক। ভাস্কর্যের পেছনে কামিলকে কোনো কৃতিত্ব দিতে নারাজ রঁদ্যা। তবু কামিল মেনে নিলেন প্রিয়তমের ইচ্ছা ও পছন্দকেই। তার পরও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়নি। রঁদ্যা বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। বিয়ের ইতি টানতেও যেহেতু রঁদ্যার আপত্তি, কামিল তাকে ত্যাগ করে স্বতন্ত্র আর্টিস্টে পরিণত হলেন। তবে মানসিকভাবে ক্রমেই ভেঙে পড়ছিলেন। জীবনের শেষ ৩০ বছর নিজেকে সরিয়ে রাখেন ভাস্কর্য ও রঁদ্যা থেকে।