ডায়ালাইসিসের ব্যয় কমাতে পদক্ষেপ নিতে হবে

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩

অধ্যাপক ডা. আছিয়া খানম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক। দীর্ঘ সময় ধরে কিডনি রোগ নিয়ে গবেষণা, অধ্যাপনা চিকিৎসায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ডায়ালাইসিস এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ 

কোন ধরনের কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস প্রয়োজন?

কিডনি ফেইলিওরের সাধারণত পাঁচটি ধাপ থাকে। প্রথম চারটি স্টেজে ডায়ালাইসিস লাগে না। পাঁচ নম্বর স্টেজকে বলা হয় এন্ড স্টেজ কিডনি ফেইলিওর। রোগীকে যখন ওষুধ দিয়ে আর কাজ হয় না তখন ডায়ালাইসিস করতে হয়। অর্থাৎ কিডনি যে রক্ত রঞ্চালন করত, পরিশোধন করত সেটা আর্টিফিশিয়াল একটি কিডনি দিয়ে মেশিনের সাহায্যে করা হয়। কিডনি ফেইলিওর যখন এন্ড স্টেজে পৌঁছে যায় তখনই আমরা রোগীদের ডায়ালাইসিস করি।

একজন রোগীকে কত বছর পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়?

একবার যদি ক্রনিক কিডনি ফেইলিওর মানে যদি পার্মানেন্ট কিডনি ফেইলিওর হয়ে যায় তাহলে রোগীকে আজীবন ডায়ালাইসিসের ওপর থাকতে হয়, যদি সে ট্রান্সপ্লান্ট না করে। ডায়ালাইসিসের একটা ডোজ থাকে, সপ্তাহে থেকে ১২ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস। মানে আমরা সপ্তাহে দুই-তিনদিন ঘণ্টার সেশন করে ডায়ালাইসিস দিয়ে থাকি। এটা হলো রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি। রোগী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন আর্টিফিশিয়াল কিডনি দিয়ে ডায়ালাইসিস করতে হবে। 

ডায়ালাইসিসের কোনো বিকল্প রয়েছে কী?

ডায়ালাইসিসের বিকল্প হলো কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট। এটাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আমরা যেমন রক্তের বদলে রক্ত দিই, চোখ নষ্ট হয়ে গেলে কর্নিয়া দিই, সেভাবে কিডনির বদলে কিডনি দিতে পারি। কিডনির অনেকগুলো ফাংশন আছে। আমরা ডায়ালাইসিস দিয়ে শুধু শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলো বের করতে পারি এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি। কিন্তু কিডনির বদলে যখন কিডনি দেয়া হয় বা ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় তখন একজন স্বাভাবিক মানুষ যেভাবে চলে, সেভাবেই তার কিডনির ফাংশন হয়। হরমোন তৈরি করা, বডির নিউট্রেশন মেইনটেইন করা, প্রেসার মেইনটেইন করা ইত্যাদি সবকিছু নিয়ন্ত্রিত থাকে। ডায়ালাইসিসের থেকে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সবচেয়ে ভালো বিকল্প।

সাধারণত কোন পর্যায়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে আসছেন? কখন এলে ডায়ালাইসিস এড়ানো যেত?

কিডনি রোগের পাঁচটি স্টেজের মধ্যে প্রথম স্টেজে সাধারণত রোগীরা আসে না। কারো ডায়াবেটিস থাকলে, উচ্চরক্তচাপ থাকলে তারা রেগুলার একটা ফলোআপ করে, তখন খুব আর্লি স্টেজে রোগটা ধরা পড়ে। হয়তো কিডনির নরমাল ফাংশনগুলো ঠিক আছে। কিন্তু ইউরিনে প্রোটিন চলে যাচ্ছে, কিডনির আল্ট্রাসনোগ্রামে হয়তো একটু চেঞ্জ পাচ্ছি আমরা, এমনও দেখা যায়। সেকেন্ড স্টেজেও খুব কম আসে রোগীরা। রোগীরা বেশির ভাগ আসে থার্ড স্টেজে। স্টেজে প্রোটিন যাচ্ছে, জিএফআর একটু একটু কমতে থাকে। এমন সময় আমাদের কাছে এলে যার ডায়াবেটিস আছে, উচ্চরক্তচাপ আছে অর্থাৎ যে বিষয়গুলো তার কিডনির সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে সেসব রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে পারি। এতে করে যে ডায়ালাইসিস দুই বছর পরে লাগত সেটা আমরা হয়তো পাঁচ বছর পর্যন্ত ডিলে করতে পারি। চেষ্টা করতে পারি যেন রোগটা বেশি ছড়িয়ে না পড়তে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, খুব আর্লি স্টেজে আসছে তখন হয়তো তার ডায়ালাইসিস লাগছেই না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ডায়াবেটিস বা হাইপ্রেসার যদি স্টেজ এক বা দুইয়ে থাকে তাহলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে ডায়ালাইসিস এড়ানো যায়, বা তার রোগের বিস্তৃতি ওখানে আটকে রাখা যায়।

ডায়ালাইসিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলুন।

ডায়ালাইসিস ডোজ দেয়ার সময় আমরা রোগীদের প্রোটিন রেস্ট্রিকশন বন্ধ করে দিই। সেই সময় তাকে প্রোটিন বেশি খেতে হয়। রোগীভেদে যেমন যদি হাইপ্রেসার থাকে, ডায়াবেটিস থাকে তাহলে সেই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রেখে যখন ডায়ালাইসিস করা যায় তখন সাধারণত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন হয় না। আমাদের দেশে রোগীদের কারো অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হয় অথবা যেসব রোগী ঠিকমতো ডায়ালাইসিস নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সেসব ক্ষেত্রে দেখা যায় হার্টফেল বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বেশি হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, অর্থের অভাবে প্রায় ৪০ শতাংশ রোগী মাঝপথে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

আমাদের দেশে সাধারণত যত কিডনি ফেইলিওর আছে তার মাত্র ২০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিস পায় বা নিতে পারে। তার মধ্যে ৫০-৬০ শতাংশ ছয় মাসের পরে আর কন্টিনিউ করতে পারে না। এবং এই রোগীদের মধ্যে শতাংশ বা তারও কম কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট নিতে পারে। আমাদের দেশে ডায়ালাইসিস অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসা। এর জন্য সরকারি পর্যায়ে ভর্তুকি নেই। ফলে খরচের শতভাগ রোগীদের বহন করতে হয়। কোনো ইন্স্যুরেন্স নেই। উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় রোগীদের ব্যক্তিগতভাবে অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। ইন্স্যুরেন্স কাভার করে, না করলে কিছুটা সরকারি ভর্তুকি পায়, কিছু ভাতা পায়, এগুলোতে হয়ে যায়। আমাদের দেশে সেসব নেই। যারা অ্যাফোর্ড করতে পারে না তাদের ভিটামাটি বিক্রি করতে হয়, কারো সাহায্য নিতে হয়। এভাবে ছয় মাস থেকে এক বছর পরে ৫০-৬০ শতাংশ রোগী আর ডায়ালাইসিস চালিয়ে যেতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা যদি কিছুটা সরকারি সহায়তা না পাই তাহলে কঠিন হয়। এর পাশাপাশি ডায়ালাইজার, যেগুলো ইমপোর্ট করতে হয় সেগুলোর ওপর ট্যাক্স ভ্যাট যদি কমানো যায় তাহলে রোগীদের ব্যয় অনেক কমে আসবে। সেসব ক্ষেত্রে তারা বেশিদিন ডায়ালাইসিস চালিয়ে যেতে পারবে।

বাংলাদেশে ডায়ালাইসিস কেন্দ্র বৃদ্ধি, খরচ কমানো চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

বাংলাদেশে ডায়ালাইসিস সেন্টার ২০০-এর মতো রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে আমরা জানি সব জেলা হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টার করার অনুমতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  এসব সেন্টারে কিছু জিনিস যদি রোগীরা ফ্রি পায় তাহলে আরো বেশি মানুষকে সেবার আওতায় আনতে পারব। ডায়ালাইজার, ফ্রিজ আনুষঙ্গিক যেসব ওষুধ লাগে সেগুলো ইমপোর্ট করতে যে ট্যাক্স ভ্যাট দিতে হয় সেগুলো যদি কমানো যায় তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। কিছু গরিব রোগীকে বিনামূল্যে সেবা দিতে হবে। প্রতিটি সেন্টারে ১০-২০ শতাংশ ডায়ালাইসিস বেড ফ্রি রাখতে হবে ধরনের রোগীদের জন্য তাহলে আমরা ডায়ালাইসিসের ব্যয়ভার কমাতে পারব, বেশি রোগীদের চিকিৎসার আওতায় আনতে পারব।

অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে কিডনি রোগীদের জন্য সীমাবদ্ধতার বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

আমাদের দেশে বিষয়ে কোনো আইনি জটিলতা নেই। আমাদের দেশে ১৯৯৭ সালে যে অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট অ্যাক্ট হয়েছিল, সেই অ্যাক্ট অনুযায়ী, বাবা-মা ভাই বোন, সন্তান-সন্ততি, চাচা-মামা, খালা-ফুপু এবং স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে কিডনি দিতে পারত। যেহেতু আমাদের দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি, ২০১৮ সালে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দাতার সংখ্যা যেন আরো বৃদ্ধি পায় সেজন্য খালাতো-মামাতো-চাচাতো-ফুপাতো ভাই-বোন এবং নানা-নানি, দাদা-দাদি যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬০-এর মধ্যে তারা দিতে পারবে বলা হয়। বিষয়ে আইনি দিক পরিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের দেশে অনাত্মীয় কারো কিডনি নেয়া যায় না। কিনেও নেয়া যায় না। সম্প্রতি মৃত ব্যক্তির কিডনি সংযোজন হয়েছে দুজন রোগীর শরীরে। পদ্ধতি যদি আরো প্রসার হয় তাহলে যাদের জীবিত ডোনার নেই তাদের কিডনি সংযোজনের হার বাড়বে। তবে যে কেউ দিতে পারবে এমন উন্মুক্ত করে দেয়ার এর অনেক খারাপ দিক আছে। আমাদের মতো গরিব দেশে অর্গান ট্রেডিং হয়ে যাবে বেশি। অনাত্মীয়কে সাজিয়ে নিয়ে আসবে অনেকে, টাকা দিয়ে বিক্রি হবে। এমন সব জটিলতা দেখা দেবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫