আমদানি সংকট

নিম্নমুখী দামেও অনিশ্চয়তা কাটছে না কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৩

আবু তাহের

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে কয়লার সরবরাহ। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে বেশকিছু দেশ। স্পট মার্কেটে তাই প্রতি টন কয়লার দাম এখন ২৩৫ থেকে ২৩৬ ডলারে ওঠানামা করছে। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে টনপ্রতি দাম কমেছে ১৭০ ডলারের মতো। জ্বালানি পণ্যটির অস্বাভাবিক মূল্যহ্রাসের পরও দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় এর সরবরাহ ঠিক রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বিদ্যমান ডলার সংকট, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নানামুখী জটিলতা এবং কয়লা সরবরাহ চ্যানেল নিয়ে উদ্বেগের কারণেই অনিশ্চয়তা। অথচ বিদ্যুৎ চাহিদায় কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো উৎপাদনে নিয়ে আসার কথাই বারবার বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।

জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে বর্তমানে কয়লার সংকট না থাকলেও দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি আমদানির আর্থিক সংকট রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে পণ্যটির নিম্নমুখী দরকেও কাজে লাগাতে পারছে না। হাতে থাকা জ্বালানি দিয়ে গ্রীষ্ম মৌসুমে উৎপাদনে গেলেও মাঝপথে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত ডলার সংক্রান্ত জটিলতায় ঋণপত্র খুলতে না পারার কারণেই সংকট। জটিলতা আগামীতে না কাটলে হুমকির মুখে পড়বে পুরো খাতটিই। তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহের পথও আগে থেকে নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে দেশের বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে আমদানিতে মূল্যছাড় পাওয়া যায়। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কম হয়। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির ক্ষেত্রেও ধরনের সুযোগ নানা দিক প্রসারিত করা যেতে পারে।

দেশে হাজার ২৬৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার চারটি বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য দৈনিক কয়লার প্রয়োজন পড়ে ১০ হাজার টন। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রস্তুত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু হলে এবং পূর্ণ সক্ষমতায় চললে দৈনিক ৪০ হাজার টনের বেশি কয়লা লাগবে। সে হিসাবে বছরে প্রয়োজন কোটি ৪৬ লাখ টন কয়লা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি প্রয়োজন। আর এটি করা গেলে বড় ধরনের মূল্যছাড় পাওয়া যায়। তারা বলছেন, কয়লার আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক দামের ওপর দরকষাকষির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত সুযোগ মেলে। তবে স্বল্পমেয়াদি চুক্তি করলে ধরনের কোনো সুযোগ নেই। বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণচুক্তি নিয়ে আমাদের চুক্তিতে অসংগতি এবং অভিজ্ঞতার দুর্বলতা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে তত্পরতা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। অথচ এগুলোর জন্য জ্বালানির সংস্থান কীভাবে হবে সেটা নিয়ে তত্পরতা দেখা যায় না। যে কারণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানির জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা উচিত। তাতে মূল্যে যেমন ছাড় পাওয়া যায়, তেমনি অনিশ্চয়তা কম থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কম পড়ে।

বাংলাদেশে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর কয়লা আমদানির বাজার ইন্দোনেশিয়া। তবে অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বাজারও রয়েছে প্রথম সারিতে। দূরত্ব কম বিবেচনায় ইন্দোনেশিয়া থেকে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়লা আমদানি করছে। বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির গত বছরের জ্বালানি আমদানির চারটি চালান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি টন কয়লা আমদানিতে গড়ে ২৫০ ডলার খরচ হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির কারণে আমদানির ওপর মূল্যছাড়ও পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে সম্প্রতি ডলার সংকটের কারণে দেশটি থেকে কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার কোনো সংকট নেই। চুক্তি করলে এবং নির্ধারিত সময়ে মূল্য পরিশোধ করা গেলে পর্যাপ্ত কয়লা পাওয়া যাবে। কেবল ডলার কয়লা আমদানি জটিলতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি জটিলতায় পড়েছে দেশের তাপভিত্তিক দুটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা রামপাল। কয়লা সংকটের কারণে উৎপাদনের ২২ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে যায় বাগেরহাটের হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। যদিও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিদর্শনে গিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার জানিয়েছেন আগামী তিন মাসের মধ্যে দুটি ইউনিটই পুরোদমে উৎপাদনে যাবে। যদিও আগামী সপ্তাহেই চালু করতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)

বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইদ একরাম উল্লাহ বলেন, ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা সরবরাহ হঠাৎ বিঘ্নিত হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় রামপাল কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন। ডলার ছাড় করতে কিছুটা সময় লাগার কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে আমরা নতুনভাবে ডলার পেমেন্ট শুরু করেছি। এরই মধ্যে একটি জাহাজ কয়লা নিয়ে রওনাও হয়েছে। 

আসন্ন গ্রীষ্ম, সেচ রমজানে বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করছে সরকার। এজন্য ভারত থেকে আদানি, চট্টগ্রামের হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এসএস পাওয়ার এবং বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে। তবে ডলার সংকট এবং কয়লা আদানির পথ পরিষ্কার না হলে এগুলো চালু করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুৎ বিভাগ বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য হাজার ৮৬৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক পাঁচটি বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি পাওয়ারের হাজার ৬০০ মেগাওয়াট এবং বাকি চারটি হাজার ২৬৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল বলছে, চাহিদার মৌসুমে যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চাহিদাকে মাথায় রেখে আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আগামী মার্চ মাস থেকে সেচ, গরম রমজানের জন্য চাহিদা শীতের তুলনায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বাড়বে। অতিরিক্ত জোগান দেয়ার জন্য কয়লা, তরল জ্বালানি গ্যাস থেকে কতটুকু উৎপাদন করতে হবে, তার জন্য কতটুকু জ্বালানি লাগবে সেটা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে চাই যে গরম, সেচ রমজানে যে চাহিদা তৈরি হবে তা পূরণে আমরা সক্ষম হব।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫