দগ্ধ

পোড়া রোগীর চিকিৎসায় দরকার স্কিন ব্যাংক গড়ে তোলা

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৩

পুড়ে যাওয়া রোগীদের দরকার বিশেষায়িত চিকিৎসা। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জাহিদ হাসান দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন পুড়ে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে। বর্তমানে তিনি জর্জিয়ার অগাস্টায় জোসেফ এম স্টিল বার্ন সেন্টারে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে কর্মরত। তাছাড়া জোসেফ এম স্টিল বার্ন সেন্টার ইনকরপোরেশনের প্রেসিডেন্ট সিইও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন বিশেষজ্ঞ। দেশে-বিদেশে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার বিভিন্ন দিক, বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা এবং সেসব কাটিয়ে ওঠার নানা পথ নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শর্মিলা সিনড্রেলা

পোড়া রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হবে?

কারো শরীরে আগুন লাগলে দেখা যায় তার আশপাশের মানুষ ভয় পেয়ে যায়। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করে, এগুলো উচিত নয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যতটা সম্ভব মাথা শান্ত রাখতে হবে। যার শরীরে বা কাপড়ে আগুন লেগেছে, তাকে দ্রুত মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি করতে হবে, যেন আগুন নিভে যায়। পাশে যারা থাকবেন তাদের উচিত ভারী কাঁথা বা কম্বল দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরা। তাতেও আগুন নিভে যায়। আর শেষ পর্যন্ত পানি তো আছেই। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় যেসব অগ্নিদগ্ধ রোগীকে আমরা পাই তার বেশির ভাগই থার্মাল বার্ন, কিছু ইলেকট্রিক্যাল বার্ন আর পাই কেমিক্যাল বার্নের খবর। কেউ আগুনে পুড়ে গেলে তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

ফার্স্ট ডিগ্রি বার্নের ক্ষেত্রে ত্বক সামান্য লাল হয়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসার তেমন কোনো প্রয়োজন হয় না। কিছু অয়েন্টমেন্ট লাগানো, ক্ষতস্থান পরিষ্কার রাখা, বাইরে না যাওয়াএগুলোই যথেষ্ট। সেকেন্ড ডিগ্রি বার্নের ক্ষেত্রে ত্বকে ফোসকা পড়ে দগদগে ঘা হয়ে যায়। ফোসকা পড়া স্থানটিকে পরিষ্কার করে অ্যামনিওটিক মেমব্রেন (সন্তান হওয়ার পরে যে স্যাকটা থাকে, সেটিকে আমাদের পরমাণু শক্তি কমিশন রেডিয়েট করে বার্ন সেন্টারে পাঠায়) দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। কিংবা পরিষ্কার করে ডোনেটেড স্কিন মেডিক্যাল গ্লু দিয়ে ওপরে লাগিয়ে দেয়া যায় অথবা সেলাই করা যায়। তারপর একটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়। সাতদিন পর পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়। সাধারণত সেকেন্ড ডিগ্রি বার্ন দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ সেরে যায়। থার্ড ডিগ্রি বার্ন বা ডিপ সেকেন্ড ডিগ্রি বার্নের ক্ষেত্রে স্কিন গ্রাফট করতে হবে। সেটা রোগীর নিজের ত্বক দিয়েও লাগানো যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে পোড়া ত্বক কেটে ফেলতে হয়। তারপর ডোনেটেড স্কিন লাগিয়ে দেয়া হয়। সাতদিন পর পরীক্ষা করা হয়, পোড়া স্কিনের যে অংশটা কেটে ফেলেছিলাম, সেখানে সুস্থ কোনো অবস্থা তৈরি হয়েছে কিনা। যদি হয়, তখন সেখানে আমরা স্কিন গ্রাফট দিতে পারি। এক্ষেত্রে প্রথমে ডার্মাটোম নামে একটা মেশিন দিয়ে স্কিনটা তোলা হয় খানিকটা পুরুত্ব ধরে। তারপর সেটা আরেকটা মেশিন স্কিন মেশারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে একটা নেটের মতো বানানো হয়। যতখানি ত্বক নেয়া হয় এভাবে করলে তা দিয়ে অনেকখানি পোড়া জায়গা কভার করা যায়।

দেশে বিদেশে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা আপনি দেখছেন? এক্ষেত্রে পার্থক্য কী দেখছেন?

আমেরিকান বার্ন অ্যাসোসিয়েশনের কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে। সেখানে, ভুক্তভোগী কি কোনো শিশু, ইলেকট্রিক্যাল নাকি কেমিক্যাল বার্ন, থার্মাল বার্ন কি ১০ শতাংশের বেশি ধরনের ১০টি ক্রাইটেরিয়া আছে। এসব ক্রাইটেরিয়ার কোনো একটিতে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে বার্ন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশেও বার্ন অ্যাসোসিয়েশন আছে। কিন্তু সেটা ততটা অ্যাকটিভ না। তাছাড়া প্রয়োজন পড়লে দ্রুত বার্ন সেন্টারে যাওয়ার জন্য মানুষকে সচেতন করার মধ্যেও ঘাটতি আছে। বাংলাদেশে দরিদ্রদের মধ্যে পোড়ার হার বেশি। তাই চিকিৎসা ব্যয়ের একটি ব্যাপার আছে। সৌভাগ্যবশত, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে টাকার ব্যাপারটিকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। এটি খুব প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

বাংলাদেশে এখন ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে?

মানুষের শরীরে স্কিন বা ত্বক হলো সবচেয়ে বড় অরগ্যান। ত্বক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ত্বকই আমাদের ওয়াটার লস থেকে রক্ষা করে এবং ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে। কিন্তু সে অনুপাতে আমরা স্কিনকে গুরুত্ব দিই না। কিডনি, চোখ, লিভার, হার্ট ইত্যাদি অঙ্গ যেমন দান করা যায়, ত্বকও তেমন দান করা যায়। পার্থক্য হলোএকটা কিডনি বা লিভারের কিছু অংশ সুস্থ থাকতেই দান করা যায়। কিন্তু ত্বক দান করা যায় মৃত্যুর পর। আদর্শিকভাবে মৃত্যুর ঘণ্টা পর ত্বক তুলে নিতে হয় এবং নেয়া যায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। ডোনেটেভ স্কিন ছাড়া ৪০ শতাংশ বার্নের রোগী বাঁচানোও খুবই কঠিন। বাংলাদেশে রকম ডোনেটেড স্কিন নেই, তাই পোড়া রোগীদের মৃত্যুর হার বেশি।

পোড়া রোগীর চিকিৎসা সীমাবদ্ধতা দূর করতে বাংলাদেশ আর কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

বাংলাদেশ স্কিন ব্যাংক তৈরি করতে পারে। সেই সঙ্গে মানুষকে সচেতন করা দরকার। স্কিন ব্যাংক করে তো লাভ নেই যদি ডোনার না থাকে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে যে স্কিন ডোনেট করলে ডার্মাটোম দিয়ে মরদেহের পিঠ থেকে থাই থেকে খানিকটা ত্বক তুলে নেয়া হয়। তাতে মরদেহের কোনো বিকৃতি হয় না। তবে যদি কোনো ডোনার বলেন যে তার পুরো শরীর থেকে নেয়া যাবে তখন তার পেট, বুক হাত থেকে নেয়া হয়। তাছাড়া সবার স্কিনও নেয়া হয় না, সংক্রামক কোনো রোগ যেমন হেপাটাইটিস বি সি, এইচআইভি, ক্যান্সার থাকলেও ত্বক নেয়া হয় না। তাছাড়া দেশে পোড়া রোগীকে চার-পাঁচদিনের আগে অপারেশন করে না। কিন্তু আমেরিকায় রোগী আসার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করে ফেলি। দেরি করলেই ইনফেকশন হয়ে যায় ফ্লুইড লস করা চলতেই থাকে। মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এসব ডোনেটেড স্কিন সংরক্ষণ করা হয়। এটিকে বলে ক্রায়োপ্রিজার্ভড। ত্বকে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা সম্পূর্ণ যাচাই করে সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে সংরক্ষিত ত্বক পাঁচ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রে ল্যাবরেটরিতে ত্বক জন্মানো যায়। বোস্টনে অবস্থিত একমাত্র ওই ল্যাবে তিন-চার সপ্তাহে অনেক পরিমাণে ত্বক তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশে এখনই তা সম্ভব না।

কোন কোন রোগ থাকলে পোড়া রোগীর চিকিৎসা আরো জটিল হয়ে পড়ে?

ধূমপায়ীদের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) থাকে। পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে রোগ সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। ডায়াবেটিস থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। হূদরোগ থাকলে অপারেশন করতে অসুবিধা হয়, অ্যানেস্থেশিয়া করতে সমস্যা হয়। কিডনি যদি ঠিকঠাক কাজ না করে, সেটিও সমস্যা বাড়াতে পারে। এগুলোকে বলা হয় কো-মর্বিডিটি। এসব ক্ষেত্রে পোড়া রোগীর বেঁচে থাকার হার অনেক কমে যায়।

অনেক সময় দেখা যায়, ত্বক বেশি পোড়েনি, কিন্তু নিশ্বাসের সঙ্গে অনেক বেশি ধোঁয়া শরীরের ভেতর ঢুকে গেছে। এসব ক্ষেত্রে ফুসফুস পুড়ে যায়। এটিকে বলা হয় ইনহেলেশন ইনজুরি। ধরনের ইনজুরির জন্য মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। পোড়া রোগীর বয়সের সঙ্গে মৃত্যুর হারের সম্পর্ক আছে। যদি কারো বয়স ৬৫ বছর হয় এবং পোড়ার হার হয় ৩০ শতাংশ, তাহলে তার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে যদি ইনহেলেশন ইনজুরি হয়, তাহলে আরো ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। তো এসব কো-মর্বিডিটিইনহেলেশন ইনজুরি, অধিক বয়সএগুলো সম্মিলিতভাবে পোড়া রোগীর অবস্থা আরো জটিল করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশে পোড়া রোগীর চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা গবেষণা কতটা আছে বলে মনে করছেন? সেক্ষেত্রে আর কী করা যেতে পারে?

বার্ন রোগীর চিকিৎসার জন্য সার্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ। অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার ডাক্তারও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ডাক্তারের ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশে ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেবা দেন অ্যানেস্থেশিওলজিস্টরা। সেক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা যেতে পারে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার থেরাপিস্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু ডোনেটেড স্কিন না, পিগ স্কিনকেও মেডিকেলি প্রসেস করে ব্যবহার করা হয় বায়োলজিক্যাল ব্যান্ডেজ হিসেবে। ফলে বড় জায়গা জুড়ে সেকেন্ড ডিগ্রি বার্ন হলেও তা দুই সপ্তাহে শুকিয়ে যায়। আবার পিগ স্কিনে কোনো জীবিত কোষ থাকে না। ফলে সেটা শরীরের অংশ হয়ে যায় না। এভাবে আমরা এখানে অনেক মুসলিম রোগীরও চিকিৎসা করি থাকি। সুতরাং ধরনের চিকিৎসায় দ্বিধান্বিত হওয়ার কিছু নেই। পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই, মুসলিম ধর্মে স্কিন বা অর্গান ডোনেশনে কোনো নিষেধ নেই। পোড়া রোগীদের বাঁচাতে হলে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে স্কিন ডোনেশনে। সে সঙ্গে ভূমিকা রাখতে হবে স্কিন ব্যাংক তৈরিতে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫