কেন ব্যাংকই মানুষের ভরসার জায়গা?

প্রকাশ: জানুয়ারি ৩০, ২০২৩

মাসরুর আরেফিন

বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে দ্রব্যের পরিবর্তে দ্রব্য (বার্টার পদ্ধতি) ব্যবহারের প্রায়োগিক সমস্যা দূর করতেই মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন হয়। মুদ্রার প্রয়োজনেই প্রাথমিক ব্যাংকিং ধারণার উদ্ভব ধরলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ইতিহাস প্রায় সাত হাজার বছরের। আবার যুদ্ধকালীন সংকট মোকাবেলায় বাধ্যতামূলক ঋণ ব্যবস্থা চালু করতে ১১৫৭ সালে চালু হওয়া ব্যাংক অব ভেনিস-কে আধুনিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় ধরলে আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার বয়স ৮৬৬ বছর। অন্যদিকে ১৬৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড-কে প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধরলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসও ৩২৯ বছরের। বাংলার প্রথম ব্যাংক হিন্দুস্তান ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৭৭০ সালে, আর ঢাকার প্রথম ব্যাংক ঢাকা ব্যাংক ১৮৪৬ সালে। সেই হিসেবে অঞ্চলে ব্যাংকের ইতিহাস ১৭৭ বছরের।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর প্রায় ১৪ কোটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গ্রাহকের আমানত আছে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা (ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত) আর ব্যাংকগুলো মোট ১৩ লাখ ৮৫ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। দেশে মোট এটিএমের সংখ্যা ১৩ হাজার ৩৮৭, পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিন আছে লাখ হাজার, ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন আছে হাজার ২১৩, আর ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন আছে হাজার ২৯১টি। একই সঙ্গে ডেবিট কার্ড আছে কোটি ৯৫ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৭, ক্রেডিট কার্ড আছে ২০ লাখ ৮৭ হাজার ১৩৬ প্রিপেইড কার্ড আছে ৩২ লাখ ৭৯ হাজার ২০টি।

গত ৫২ বছরে রকম একটা শক্ত ভিত আয়োজনের পরেও ব্যাংক খাতে সংকট যে নেই তা নয়। সংকট আছে, আছে অস্থিরতাও। মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, সুদহারে স্থিরতা, ডলার সংকট, বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর ঋণ আদায়ে স্থবিরতা পাঁচটাই খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেমন নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, ব্যাংকগুলোও সেসব মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেল নিত্যপ্রয়োজীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের মুদ্রাস্ফীতি ডিসেম্বরে দশমিক ৭১ শতাংশে উঠেছিল। বাস্তবে হার হয়তো আরো বেশি। ফলে মানুষের কাছে সঞ্চয়যোগ্য টাকা কমে এসেছে। তার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধির ওপর। ২০২২ সালের জুনে আমানত বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল দশমিক ৯০ শতাংশ, নভেম্বরে সেই প্রবৃদ্ধি নামে দশমিক ৬৮ শতাংশে।

কিছুদিন আগে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার একটা হিড়িক পড়েছিল। আতঙ্কিত মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। ফলে মানুষের কাছে বা হাতে যে টাকা, সেই টাকার পরিমাণ নভেম্বরে বেড়ে লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছিল। সেই আতঙ্ক এখন অনেকটা কমেছে। মানুষ আবার ব্যাংকে ফিরে আসছে। ফলে মানুষের হাতে হাতে থাকা টাকার পরিমাণ কমে লাখ ৯২ হাজার কোটিতে নেমে এসেছে ডিসেম্বরের শেষেই। মানুষ ব্যাংকেই আস্থা রাখছে, রাখবে। আমি যে ব্যাংকে কাজ করি, সেই সিটি ব্যাংকের আমানত জানুয়ারির ২৫ দিনে নিট ৬২১ কোটি টাকা বেড়েছে।

মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে যেসব কারণে, অর্থাৎ টাকার নিরাপত্তা প্রাপ্তি, চাহিবামাত্র সেই টাকা তোলার স্বাধীনতা এবং মুনাফা বা সুদ পাওয়া, সেগুলো নিশ্চিতভাবে দিতে পারে একমাত্র ব্যাংকই।

বাংলাদেশ মজবুত এক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের বড় অর্থনীতির দেশ। করোনা মহামারী ইউক্রেন যুদ্ধের পরেও গত পাঁচ বছরে দেশের জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি দশমিক শতাংশ। বৈশ্বিক সঞ্চয়ের হার যেখানে ২৭ শতাংশ, বাংলাদেশে সঞ্চয়ের হার সেখানে ৩৪ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক শতাংশ মানুষই কর্মক্ষম এবং জনসংখ্যার গড় বয়স ২৮ বছর। দেশ অনলাইন শ্রমশক্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয়, বিশ্বের ফ্রিল্যান্সারদের ১৫ শতাংশ বাংলাদেশী, এখানে ফেসবুক অন্ট্রাপ্রেনিউর আছে ৫০ হাজারের ওপরে, আর গড়ে মাত্র শতাংশ জিডিপি বাড়লেও ২০৪০ সালে বাংলাদেশ হবে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। দেশের অগ্রযাত্রায় নিঃসন্দেহে ব্যাংক হলো প্রধান স্তম্ভ।

সমস্যা আছে অবশ্যই, যেমন কোনো কোনো ব্যাংকে মন্দ ঋণের সমস্যা, কোথাও বড় আকারে সুশাসনের সমস্যা, কোথাও ঋণ প্রদানে শৃঙ্খলার বিরাট অভাব। কিন্তু গত ৫২ বছরে দেশের কোনো ব্যাংক ধসে যায়নি। সব সমালোচনার পরও ব্যাংক ব্যবস্থায় রয়েছে তারল্য উদ্বৃত্ত তারল্যের উপস্থিতি, আর রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বক্ষণিক কড়া চোখ। তাই ভরসা রাখুন ব্যাংকেই।

মাসরুর আরেফিন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড ভাইস চেয়ারম্যান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫