ব্রেইনের ভুল বার্তাই প্যানিক অ্যাটাকের কারণ

প্রকাশ: জানুয়ারি ৩০, ২০২৩

শর্মিলা সিনড্রেলা

সেদিন শাওনের ঘুম ভাঙল ভোরবেলা। আগে আগে ঘুম ভাঙায় বেশ খুশিই হলেন বেসরকারি কর্মজীবী। নিজের মতো খানিকটা সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু হুট করেই বদলে গেল সবকিছু। শুয়ে শুয়েই কিছু একটা ভাবছিলেন। সেই ভাবনা পৌঁছে গেল শরীর খারাপের দিকে। নিমেষেই চারপাশের সবকিছু দুলে উঠল, বুকের মধ্যে ধড়ফড় করতে শুরু করল, একপর্যায়ে গিয়ে মনে হলো মৃত্যু এসে গেছে। হাত-পা কাঁপা আর চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসা শুরু হলে তিনি পাশে থাকা বন্ধুকে ঘুম থেকে তুললেন। পরে জানা গেল, তিনি আসলে প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হয়েছিলেন।

এমন ঘটনা শোনা যায় অনেকের মুখে। সমস্যার মূল খুঁজতে তারা যান মেডিসিন বা কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞের কাছে। কিন্তু কোনো রোগ মেলে না। তখন চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, তিনি আসলে প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হয়েছিলেন।

প্যানিকের বাংলা অর্থ আতঙ্ক। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের ব্রেইনের ভেতরে বেশকিছু অংশ আছে। কিছু আছে কষ্টের কেন্দ্র, কিছু আছে রাগের কেন্দ্র, কিছু আনন্দের কেন্দ্র আর কিছু ভয়ের কেন্দ্র। আমরা যখন বিপদে পড়ি তখন ব্রেইন আমাদের সিগন্যাল দেয় যে এখন ভয়ংকর কিছু ঘটছে। তখন হয় আত্মরক্ষার জন্য আমরা ফাইট করি, তা না হলে ফ্রিজ হয়ে যাই। ব্রেইনের মেকানিজম এমন ধরনের যে সে আমাদের সিগন্যাল দেবে যেন আমরা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারি। আর সেটা সে দেবে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের ব্রেইনে এমন কিছু সমস্যা বা রোগ থাকে যে জরুরি বা বিশেষ কোনো ভয়াবহ ঘটনা না ঘটলেও ব্রেইন মনে করে অ্যাটাক হতে যাচ্ছে। প্যানিক অ্যাটাকের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোই এখানে।

প্যানিক অ্যাটাকের বেশকিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, বুক চেপে আসা, গলা শুকিয়ে আসা, পেটে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘোরানো, কানে শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া ইত্যাদি। এমন হলে আমাদের ব্রেইনে সিগন্যাল যায়, মনে হয় হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে বা মারা যাচ্ছি। যদি ব্রেইনে সিগন্যাল না যেত তাহলে এসব শারীরিক সমস্যা তেমন একটা বড় হতো না। কিন্তু মৃত্যুর ভয় যখন মানুষের মনে ঢুকে পড়ে তখন শরীরে মনে তার কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। তাজুল ইসলাম বলেন, প্যানিক অ্যাটাকের মূল কারণ হচ্ছে এমন একটা ভুল সিগন্যাল বা ভুল বার্তা ব্রেইনে যাওয়া। আক্রান্তের তখন এত বেশি খারাপ লাগে যে সে কার্ডিওলজিতে গিয়ে ইসিজি বা এনজিওগ্রাম করে। কিন্তু দেখা যায় হার্টে কোনো সমস্যা নেই। সত্যি বলতে রোগী তখন আসলে খারাপ লাগা অনুভূতির মধ্য দিয়ে যায়। যদিও তার শরীর খারাপ নেই কিন্তু ব্রেইন মনে করে তার খারাপ কিছু একটা হয়েছে।

মনের ভেতরে এভাবে ভয়াবহ একটা চিন্তা ঢুকে পড়া একটা মানসিক রোগ। তাই তা থেকে মুক্তি পেতে ঠিকঠাক চিকিৎসা নিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্তদের বোঝাতে হবে এটা মনের মধ্যে থাকা একটা আতঙ্ক বা ভয়, বাস্তবে আসলে তেমন কিছু হচ্ছে না। অতএব এভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাদের বোধ চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। তাছাড়া ওই খারাপ লাগার সময়ে মনোযোগ অন্যদিকে নিতে হবে। কারো সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে বা কোনোভাবে মনোযোগ যদি ডাইভার্ট করতে পারে তাহলে ব্রেইনে ওই সিগন্যাল কমে যাবে আর ভয় থাকবে না। ধীরে ধীরে সে নরমাল হয়ে যাবে। ধরনের রোগীদের আমরা কগনিটিভ থেরাপি দিই, ব্রিদিং এক্সারসাইজ দিই। সেই সঙ্গে কিছু ওষুধও দিয়ে থাকি।

প্যানিক অ্যাটাককে অনেকে হার্ট অ্যাটাক ভেবে ভুল করেন। আদতে প্যানিক অ্যাটাক হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য রয়েছে। হার্ট অ্যাটাক রোগীকে আতঙ্কগ্রস্ত করবে না, তবে বুকে ব্যথা করবে। হার্ট অ্যাটাক সিগন্যালও দেবে না যে মৃত্যু এসে গেছে। আর প্যানিক অ্যাটাক হলে মনে শুধু ভয় কাজ করে। আতঙ্কের বিষয়টা হচ্ছে মানসিক। হার্ট অ্যাটাক মানসিক না। তাছাড়া প্রথমবারে আক্রান্ত হওয়ার পর যখন রোগীর ইসিজি বুকের এক্স-রে করে দেখা যায় হার্টে কোনো সমস্যা নেই, তখন বোঝা যায় যে আসলে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে।

তাজুল ইসলাম বলেন, প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীর মনে ভয় কাজ করে, আবার মনে হয় এমন হবে। পরবর্তী সময়ে অনেক সময় সেটা ফোবিয়ায় পরিণত হতে পারে। সে দূরে একা যেতে পারে না ভয়ে। ভাবে রকম হলে কে আমাকে দেখবে, কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? প্যানিক অ্যাটাক থেকে ফোবিয়া এসে গেলে ব্যক্তি দুটি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়।

আবার উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা নিজেই হূিপণ্ডের ওপর চাপ তৈরি করে আর আতঙ্ক তো ভয়াবহ ধরনের উদ্বেগ। প্যানিক অ্যাটাক বারবার হতে থাকলে এটা শরীরের বিভিন্ন অংশের ওপর প্রভাব ফেলে। ভয় পেলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গেই বিভিন্ন লক্ষণের উত্পত্তি হয়। যদিও তার কয়েকটা ছাড়া সবগুলো দেখা যায় না।

ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হলে রোগীকে মানসিক রোগের চিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে। তাজুল ইসলাম বলেন, শুধু সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ে রোগ সারবে না, ওষুধও নিতে হবে। পরবর্তী সময়ে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি দিয়ে দেখতে হবে যেন বারবার এমন অ্যাটাক না হয়। তবে ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্টের কাছে রোগের সমাধান মিলবে না। শুধু মুখের কথায় কাউন্সেলিং দিয়ে উপকার পাওয়া যাবে না। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে ওষুধও পাওয়া যাবে, আবার কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপিও পাওয়া যাবে। যদিও কেউ কেউ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধায় থাকেন। সেক্ষেত্রে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে তাকে বোঝাতে হবে যে এটা এমন রোগ যা সারাতে মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং নিয়মিত চিকিৎসা নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫