প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় মানব পাচারের ঘটনা বেশি

দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে হবে

প্রকাশ: জানুয়ারি ৩০, ২০২৩

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে চরম দরিদ্র্য হয়ে পড়ছে। পাচারকারীরা সহজেই তাদের প্রলুব্ধ করার সুযোগ পেয়ে বাস্তুচ্যুত এসব মানুষকে ফাঁদে ফেলছে। জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে যেসব মানব পাচারের ঘটনা শনাক্ত করা গেছে তার বেশির ভাগই ঘটেছে ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগীয় অঞ্চলে। তবে সবচেয়ে বেশি মানব পাচার হওয়ার ঘটনা ঘটে খুলনা বিভাগে। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিনিয়ত বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবন এলাকার ফসল ও সম্পত্তি নষ্ট হয়। ২০১৪ সালে এখানকার ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এ এলাকার মৎস্য আহরণের কাজে জোরপূর্বক ও বাধ্যতামূলক শ্রম দেখা গেছে। প্রায়ই এসব এলাকায় শিশুকে কাজে বাধ্য করা হয়। এ পরিস্থিতি মানব পাচারকারীদের সুযোগ করে দিয়েছে। ঋণগ্রস্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে তারা পাচার করে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যখন উন্নত জীবনের খোঁজে ঢাকা অথবা কলকাতায় আশ্রয় নেয় তখনো তারা পাচারকারী এজেন্টদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং শোষণের শিকার হয়। জনশক্তি রফতানি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম ক্ষেত্র, যা রেমিট্যান্স আকারে দেশে আসছে। কিন্তু অবৈধ অভিবাসনের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে জনশক্তির বাজার বিনষ্ট হচ্ছে। বিদ্যমান অবস্থায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও বৈধ প্রক্রিয়ায় জনশক্তি রফতানির সুযোগ সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। 

সরকারের উচিত সম্ভাবনাময় অভিবাসীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করা এবং তাদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশ ত্যাগের আগে অভিবাসীদের আরো উন্নত ও প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করা এবং বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যও বিনিয়োগ করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দিনশেষে এ অপরাধের প্রকৃতি বিচারে এবং পাচারকারীদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বিবেচনায় সরকারকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সুসংগঠিত মানব পাচার ও চোরাচালানের নেটওয়ার্কগুলোকে অকার্যকর করে এ অপরাধকে দমন করতে হবে।

বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে মানুষ কেন মানব পাচারের শিকার হয় সে প্রশ্নের উত্তরে দুটি বিষয়কে সর্বাধিক আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, অসচ্ছলতা এবং দ্বিতীয়ত, বেকারত্ব। অসচ্ছলতা আর বেকারত্ব তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার লোকজন অবৈধ পথে বিদেশে যান! কেন এ এলাকাগুলো ঘিরেই দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী দালাল চক্র গড়ে ওঠার সুযোগ মেলে! বিভিন্ন সময়ের গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা থেকে জানা যায়, লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে ইউরোপ যাত্রায় এসব মধ্যবিত্ত যুবককে লিবিয়া বা ভূমধ্যসাগর তীরের আশপাশের দেশে নিয়ে, সেখানে তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে বড় মাপের মুক্তিপণ আদায় করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পাচার চক্র। এক যুগের বেশি সময় এ অমানবিক কাজ চলছে! মনে রাখতে হবে, অবৈধ অভিবাসনের চক্রগুলো সারা বছর ধরেই মানব পাচার করে। তবে যেহেতু এরা প্রতিবার নতুন কৌশল আর পথ ব্যবহার করে কাজ করে, তাই মহামারী ও দুর্যোগজনিত অস্থিরতার সুযোগ তারা নেবেই। এটি সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসাগুলোর অন্যতম। 

দালাল চক্র শুরুর দিকে বিমানে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড নিয়ে তারপর ‘টারজান’ ভিসা লাগিয়ে জঙ্গলের পর জঙ্গল হাঁটিয়ে রাতের অন্ধকারে ট্রাকে, মালগাড়িতে, নৌকায় পাচার শুরু করে। মাঝারি গোছের একজন পাচারকারী যদি প্রতি কেসে কমপক্ষে কয়েকশ ডলার বা ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা পায়, তাহলে এর চেয়ে লাভজনক কাজ আর হতে পারে না। এ দালালদের রাজনৈতিক যোগাযোগ এত পোক্ত যে মানুষ এদের কথা প্রকাশ্যে বলে না। পুলিশ মামলা নেয়া তো দূরের কথা, সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত নেয় না। পাচারকারী চক্রের হোতারা বরাবরই তাদের অপরাধের জন্য বড় ধরনের বিচার বা শাস্তির বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যেতে সক্ষম হয়! বিচারহীনতার কারণে সমাজে এদের অবাধ বিচরণ। 

সরকার নারী ও শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করাসহ পুলিশ সদর দপ্তরে স্থাপন করা হয়েছে মনিটরিং সেল। সুসংঘবদ্ধ পাচারকারীরা বছরের পর বছর এ অপরাধ সংঘটিত করে চললেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় মনোভাবের কারণে। কাজেই মানব পাচার রোধে সরকারকে আরো কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যতই সচেতনতামূলক প্রচারণা হোক না কেন, জীবিকার মানোন্নয়ন ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে যেমন মৎস্য চাষ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ, ভ্রাম্যমাণ কম্পিউটার প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীত ভাতা এবং অসচ্ছল শনাক্তকৃত প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা দেয়া হচ্ছে। ভিজিডির আওতায় দুস্থ, অসহায় ও হতদরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীদের প্রতি মাসে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল বিতরণ ছাড়াও আয়বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণসহ ভাতা প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘আমার বাড়ি আমার খামার’-এর সমিতির মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে সাধারণ ঋণ দেয়া হচ্ছে, যাতে সমাজের কেউ পিছিয়ে না পড়ে। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, যেগুলো সার্বিকভাবে নিঃসন্দেহে মানব পাচার থেকে রক্ষা পেতে অবদান রাখছে। তবে মানব পাচার প্রতিরোধে ও দমনে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস আরো শক্তিশালী করা জরুরি। সব পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনবল বৃদ্ধিসহ, যানবাহনের সংখ্যা এবং বিশেষ করে কোস্টগার্ডের টহল বোটের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তদুপরি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মানব পাচারবিষয়ক কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা গেলে তারা মূল্যবান ভূমিকা পালন করবেন। যেসব পথে বা পয়েন্ট দিয়ে সাগরপথে মানব পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেসব জায়গা আলোকিত করে সিসিটিভির আওতায় আনা যেতে পারে। মানব পাচারবিষয়ক নিয়মিত সভা এবং এতে সংশ্লিষ্ট সবার আরো কার্যকর অংশগ্রহণ দরকার। মানব পাচার চক্রান্তে জড়িতদের ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালের জনবলও বাড়ানো প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকারের গোচরে এলে পাচারের শিকার বিদেশকর্মীদের দেশে ফেরত আনার পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। ফেরত আসার পর পাচারের শিকার নারী বা পুরুষের বিমর্ষ চেহারা বলে দেয় তাদের জীবনের ভয়াবহতা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় অনেকটা আড়ালে চলে যায় কে বা কাদের শিকার হয়ে তাদের জীবনে নেমে এল এমন দুর্বিষহ অবস্থা। কেন, কীভাবে তারা শিকার হলো, কে বা কারা জড়িত, উদ্দেশ্য কী— মানব পাচারের সেই বিষয়গুলো থেকে যায় অজানা। তবে ভুক্তভোগীরা এ অপরাধ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে, ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত ও উদ্ধার এবং পুনর্বাসনের পথে সহায়তা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশে মানব পাচারকে নিরোধের লক্ষ্যে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২’ প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে ভোগান্তির শিকার মানুষের অভিজ্ঞতাকে। বাংলাদেশ বৈধ অভিবাসনের মাধ্যমে অর্জিত রেমিট্যান্স দিয়েই অর্থনীতির মজবুত ভিত্তি গড়তে সক্ষম হয়েছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের ভালো ভাবমূর্তি রয়েছে। জাতীয় স্বার্থেই অভিবাসনের নামে মানব পাচার রুখতে হবে। এক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করে যত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় ততই মঙ্গল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একসঙ্গে গুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে সুফল আসবে বৈকি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫