বিশ্লেষণ

ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি

প্রকাশ: জানুয়ারি ২৮, ২০২৩

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

ব্যাংক ব্যবস্থা দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার যাত্রা। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ১৯৭২ এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। দেশের অর্থনীতির আকার বাড়তে থাকলে আশির দশকের প্রথম দিক থেকেই বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। বর্তমানে দেশে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি ব্যাংক, নয়টি বিদেশী ব্যাংক ও তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক এবং ৩৪টি দেশী-বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিকে সামাল দিচ্ছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর এবং প্রকাশিত বেশকিছু নিবন্ধ পাঠে জানা যায় যে বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। অবশ্য ব্যাংক খাতের সমস্যা দীর্ঘদিনের। প্রথমত, সুশাসনের অভাব। ব্যাংক যারা পরিচালনা করছেন এবং যারা কর্মকর্তা হিসেবে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন তাদের অধিকাংশের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। দ্বিতীয়ত, যেসব আইন-কানুন, নীতিমালা, বিধি-বিধানের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালিত হওয়ার কথা সেসব যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। তৃতীয়ত, ব্যাংকের অনেক পরিচালকের মধ্যেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। এদের কেউ কেউ নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। চতুর্থত, ঋণ গ্রহণের নামে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করছে না। দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। পঞ্চমত, পরিচালনা পর্ষদে নিয়োজিত কিছু পরিচালক ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে বিশেষ করে ঋণ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। সর্বোপরি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর তদারকির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

একটি দেশের অর্থনীতি ব্যাংক খাতের ওপর ভর করে চলে, অথচ বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আস্থার সংকট। আমানতকারীদের মুনাফা দেয়া হয় ৩ থেকে ৬ শতাংশ হারে। এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে আমানতের টাকা খোয়া যাওয়ার ভয়। যদি কোনো ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, সরকার হয়তো জনগণের টাকা দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু আমানতকারী ও গ্রাহকদের হয়রানি সহজে মিটবে না। এ পর্যন্ত যারা ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের কম সংখ্যককেই বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। সেজন্য ক’দিন আগেও গুজব ছিল, অনেকে ব্যাংকে সঞ্চিত টাকা উঠিয়ে ঘরে নগদ রেখে দিচ্ছে কিংবা বাধ্য হয়ে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করছে।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দুর্বল করপোরেট শাসন ব্যবস্থা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতার অভাব বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। এখানে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করে এমন সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যাদের আসল আগ্রহ অন্যত্র। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকরা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে।’

ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া কাগজে-কলমে খুব সহজ নয়। চালু ব্যবসা বা শিল্প-কারখানা থাকলে বিভিন্ন বিধি পদ্ধতি পরিপালন করে জামানতের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। স্টার্টআপ শিল্পে ঋণ পেতে হলে প্রকৃত জামানতের সঙ্গে ঋণগ্রহীতার পরিচিতিও ভালোভাবে দেখা হয়। ঋণ গ্রহণের পর নির্ধারিত সময় থেকেই ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হয়। দুই যুগ আগেও এ নিয়মের ব্যত্যয় করতে ব্যাংক কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিংবা পরিচালনা পর্ষদকে দেখা যেত না। কিন্তু পর্যায়ক্রমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইনের শাসন ও নীতি-নৈতিকতার চরম অবনতি ঘটতে থাকে। পরস্পর যোগসাজশে সম্পত্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি হতে থাকে। ঋণ দীর্ঘদিন খেলাপি হওয়ার পর দেখা যায় ঋণগ্রহীতার দেয়া জামানত ঋণ আদায়ের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকদের ইচ্ছায় অনেক ঋণ দেয়ার পর সেগুলো অনাদায়ী হয়ে পড়ে।

বর্তমানে ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যাই হচ্ছে খেলাপি ঋণ। অনেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে এবং তাদের ব্যবসা বা শিল্প-কারখানা সচল থাকলেও ঋণ পরিশোধ করছে না। কয়েক বছর পর পর আসল টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুদ মওকুফ করিয়ে নিচ্ছে। দুই বা চার কিস্তি পরিশোধ করে আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

ছোট ছোট ঋণগ্রহীতার ওপর ব্যাংকের কড়া নজরদারি, পিডিআর অ্যাক্টে মামলা ইত্যাদি থাকলেও প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের ধরতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কঠোর হতে পারছে না। খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলে বিভিন্ন সময়ে ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা ও প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ঋণখেলাপিদের মাত্র ২ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সুবিধা দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় ঋণ পুনঃতফসিল করে অনেক ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী আরো নতুন ঋণ গ্রহণ করে। নভেল করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে সরকার ব্যবসায়ীদের প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এ প্রণোদনার অর্থ কম পেলেও বড় বড় ব্যবসায়ী ও তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ীরা বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ টাকা ঠিকই উঠিয়ে নেন। এছাড়া করোনাকালে ঋণের কিস্তি প্রদানও স্থগিত রাখা হয়।

ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাংকের টাকা সহজে পৌঁছানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতের সুদের হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ এবং ঋণ প্রদানের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। তফসিলি ব্যাংকগুলো যাতে বেশি হারে ঋণ দিতে পারে এবং তারল্য সংকট না হয় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত স্ট্যাটুটরি রিজার্ভ রেশিও (এসআরআর) এবং ক্যাশ রিজার্ভ রেশিওর (সিআরআর) পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়।

উল্লিখিত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ঋণগ্রহীতারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে আবার খেলাপি হচ্ছেন। ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করলে সেসব মামলা বছরের পর বছর ধরে চলে। কখনো কখনো বড় ঋণগ্রহীতাদের কেউ কেউ উচ্চ আদালতে গিয়ে ঋণখেলাপি হওয়া স্থগিত করে নিয়ে আসছেন।

বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত তা নিয়ে নানা মত ও যুক্তিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে প্রদত্ত ২ শতাংশ ঋণ জমা দিয়ে খেলাপি থেকে উদ্ধার পাওয়ার সুবিধা ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে আরো এক নজিরবিহীন সুবিধা প্রদান করে। খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে, আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এছাড়া পরিশোধের সময় বাড়িয়ে আট বছর করা হয়েছে যা আগে ছিল সর্বোচ্চ দুই বছর।

এত সুবিধা দিয়েও কি খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হলেও আইএমএফের মতে এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে। অনেক প্রসিদ্ধ ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদের মতে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কারণ বিগত কয়েক বছরে ‘বিধিগতভাবেই’ খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীরা সরকারের বিভিন্ন সময় ঘোষিত প্রদত্ত সুযোগের অপব্যবহার করেছেন। ঋণ পরিশোধ না করে তারা পরবর্তী সুযোগের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। ব্যাংকগুলো সুযোগ বুঝে ‘রাইট অফ’ করে কিংবা ‘প্রভিশন’ রেখে ঋণ লুকিয়ে লভ্যাংশ ঘোষণা করছে। কাদের টাকা থেকে ‘রাইট অফ’ বা প্রভিশন’ করা হচ্ছে? এসব লাখ লাখ কোটি টাকা আমানতকারীদের। কোনো ব্যাংক বিপদে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকার যে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে তাও দেশের জনগণের করের টাকা।

ব্যাংকের টাকা শুধু খেলাপি হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। নানা অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট কিংবা আত্মসাৎ হয়েছে। কয়েকটি আলোচিত জালিয়াতির ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।

(১) ২০১১ সালে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়। এ পর্যন্ত কোনো টাকা আদায় হয়নি। (২) ২০১১-১২ সালে বেসিক ব্যাংক থেকে যোগসাজশ ও অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়, যার বেশির ভাগই এখনো অনাদায়ী। (৩) ২০১২-১৩ সালে ‘বিসমিল্লাহ গ্রুপ’ জনতা, প্রাইম, যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহজালাল ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গ্রুপের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশে পালিয়ে যায়। (৪) এনন টেক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ছয় বছরে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে পড়ে। (৫) ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা এবং সরকারের নগদ সহায়তা তহবিল থেকে রফতানির নামে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এ ঘটনায় গ্রুপের চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অন্যরা বিদেশে পালিয়ে গেছে। (৬) অনিয়মিতভাবে ঋণ প্রদান ও কিছু উদ্যোক্তার আত্মসাতের ফলে ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের সঞ্চিত টাকা ফেরত দিতে পারেনি। সরকারি উদ্যোগে এ ব্যাংক বাঁচাতে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ সংস্থা মূলধন জোগান দেয়। ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে এখন পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়েছে। ঋণের টাকাও আদায় হচ্ছে না, অনেক গ্রাহককেও তারা টাকা পরিশোধ করতে পারছে না বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাত্কৃত টাকাও আদায় নাকি হয়নি। (৭) ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। এ ব্যাংকের প্রদত্ত ঋণের ৯৭ শতাংশই খেলাপি বা আত্মসাৎ হয়েছে বলেও পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।

এছাড়া সম্প্রতি ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। এসব টাকা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনবিহীন কোম্পানি, সদ্য প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি, অস্তিত্বহীন কোম্পানি ইত্যাদির নামে নামমাত্র জামানতের বিপরীতে দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

উল্লিখিত অনিয়ম ও জালিয়াতির যেসব ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে তার একটি বড় অংশ এবং সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে অনেকে সন্দেহ করেন। ঋণ নিয়ে ব্যবসা মন্দা বা ক্ষতি হওয়ার কারণে খেলাপি হওয়ার চেয়ে ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণখেলাপি বেশি ভয়ংকর।

ঋণ আদায়ে ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কঠোর না হওয়ার কারণে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয় দেশে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর নৈতিকতা ও দেশপ্রেম বলতে কিছুই নেই। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রদত্ত মোট ঋণের ২২-২৫ শতাংশই খেলাপি হয়ে যাবে—এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

বৈশ্বিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অবরোধ, পাল্টা অবরোধ ইত্যাদির ফলস্বরূপ বাংলাদেশের অর্থনীতিরও এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎস্বল্পতা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও দুর্নীতির ব্যাপকতা। এর মধ্যে কোনো এক বা একাধিক ব্যাংক যদি আগের আল বারাকা, ফারমার্স কিংবা বিসিআইয়ের মতো সমস্যায় পড়ে তাহলে অপপ্রচার, গুজব ও আতঙ্ক অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জনগণের করের অর্থে সহায়তা দিয়ে লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখা কোনো সমাধান নয়, বরং সমস্যার আসল কারণ খুঁজতে হবে এবং তার সমাধান করতে হবে

কিছু সংখ্যক সামর্থ্যবান উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর প্রচেষ্টায় ও প্রাথমিক অর্থায়নে বেসরকারি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা হয়। এর মাধ্যমে তারা ব্যাংক মালিক হয়ে বসেন। পরবর্তী সময়ে তাদের অর্থায়নকৃত টাকার শতগুণ সাধারণ গ্রাহক ও আমানতকারীরা ব্যাংকে জমা করেন। অনেক উদ্যোক্তা পরিচালক তার বিনিয়োগকৃত টাকা পরবর্তী সময়ে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে উঠিয়ে ফেলেন। সত্যিকার অর্থে আমানতকারী ও গ্রাহকরাই ব্যাংকের প্রকৃত মালিক। তাদের স্বার্থ দেখা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অবশ্য কর্তব্য। দুঃখের বিষয়, ৯-১০ শতাংশ উচ্চমূল্যস্ফীতির সময়ে আমানতকারীরা সুদ বা মুনাফা পাচ্ছে মাত্র ২-৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণায় যদিও আমানতের সুদের সীমা তুলে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ঋণের সুদের সীমা ৯ শতাংশই রেখে দেয়া হয়েছে (ভোগ্যপণ্যে প্রদত্ত ঋণের সীমা তুলে নেয়া হয়েছে)। ফলে আমানতকারীরা খুব বেশি লাভবান হবেন না। অবিলম্বে সুদের হারের সীমা প্রত্যাহার করা হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নৈতিক দায়িত্ব। সুদের হার কমিয়ে ঋণপ্রাপ্তি সহজ করলেই যে দেশে বিনিয়োগ হবে এমন কোনো কথা নেই। এতে ঋণের অপব্যবহার ও অদক্ষতার সম্ভাবনা থাকে। বাজার ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে জোর করে সুদের হার দীর্ঘ সময় কমিয়ে রাখা ঠিক নয়। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রদানে সুদের হার ৯ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখলেও আমানতের সুদহারের ক্যাপ প্রত্যাহার করেছে। এতে ব্যাংক আমানতকারীদের কিছুটা সুবিধা দিতে পারলেও বর্তমান মূল্যস্ফীতির সমপরিমাণ সুদ দিতে পারবে না।

আইএমএফ ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানের শর্ত হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের কথা বলেছে। ব্যাংকিং আইন জনকল্যাণমুখী (শুধু কার্যত মালিক ও ঋণগ্রহীতাদের অনুকূলে নয়) করা, কর ও অর্থ ব্যবস্থাপনার সংস্কার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ও দায়বদ্ধতা ফিরিয়ে আনা—এসব ব্যাংকসংশ্লিষ্ট শুভাকাঙ্ক্ষী ও জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ঘাটতি দৃশ্যমান। বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে নিয়মিত অবহিত করার কথা। এ কারণে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত যেকোনো অনিয়মের দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সবার ওপরই বর্তায়।

এ কথা অনস্বীকার্য যে ব্যাংকগুলোয় কাগজে-কলমে কোনো তারল্য সংকট নেই। কিন্তু মন্দ ঋণের কারণে তাদের প্রচুর অর্থ আটকে যাওয়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ী বা ভালো গ্রাহকদেরও ঋণ দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া আমানতকারী ও সঞ্চয়কারীরাও স্বল্প মুনাফায় নিরুৎসাহী হয়ে ব্যাংকবিমুখ হচ্ছে। এটি ভালো লক্ষণ নয়।

প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে ছিল, যা ২০১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে। করোনা মহামারীর সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকে, যার ফলে দেশের মাথাপিছু আয় ২০২২ সালে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার পৌঁছে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালেই জাতিসংঘের ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উঠে গেছে। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বেশি। তবে দেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে। দেশের জিডিপির আকার প্রায় ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ পরিস্থিতিতে এক শ্রেণীর দেশপ্রেম-বিবর্জিত ধনাঢ্য ব্যক্তি যদি বিদেশে সম্পদ পাচার করে তবে উন্নয়নের সুফল দেশবাসী ভোগ করতে পারবে না। 

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে হুন্ডি ব্যবসা বেড়ে যাওয়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বড় বড় রফতানিকারকের রফতানি আয়ের বড় অংশ বিদেশে রেখে দেয়া এবং যথাসময়ে রফতানি আয় দেশে না আনা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ী সংগঠন রফতানি, আমদানি, রেমিট্যান্স প্রভৃতির ক্ষেত্রে ডলারের সঙ্গে টাকার বিভিন্ন মূল্যমান নির্ধারণ করে দিয়েছে। মূল্যমানে সমতা না থাকাও বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমতে থাকা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, ডলারের অবৈধ ব্যবসা, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এত অধিক হারে ডলার ছাড়করণ—এসব শুধু রেমিট্যান্স কম আসা এবং আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়নি। ডলারের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে কিছু ব্যাংকসংশ্লিষ্ট পরিচালক ও কর্মকর্তা এবং এক্সচেঞ্জ হাউজও জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এর মধ্যে বিত্তশালী অর্থ পাচারকারীদের কারসাজি রয়েছে। কিছু কিছু ব্যাংক বা মালিক সংশ্লিষ্টদের পরিচালিত এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রবাসী আয় থেকে ডলার সংগ্রহ করে দেশে না পাঠিয়ে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপে পাঠাচ্ছে। একই সঙ্গে এসব পাচারকারী হুন্ডি ব্যবসারও অংশীদার।

উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হলো, মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন সাবেক গভর্নর এবং ব্যাংকসংশ্লিষ্ট কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত রেখেছেন, সরকার যাতে দ্রুত সৎ ও অভিজ্ঞ লোকদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের দিকে নজর দেয়। দ্বিতীয়ত, দুষ্টচক্র ও লুটেরাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে জনগণের অর্থ আর লুণ্ঠিত না হয়। অনিয়মিতভাবে গৃহীত ঋণের টাকা ফেরৎ আনতে হবে। ব্যাংক আইনের কঠোর প্রয়োগ এক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনতে পারে। তৃতীয়ত, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সৎ, সাহসী ও আইনানুগ ভূমিকা নিশ্চিত করা যাতে অনিয়ম ও অন্যায় কাজে তাদের যোগসাজশ বন্ধ হয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যাতে আরো বড় অঘটন না ঘটে সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সতর্ক থাকতে হবে।


মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

বর্তমানে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫