ডা. মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান। দীর্ঘদিন স্নায়ুরোগের চিকিৎসা, অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন এ স্নায়ুবিশেষজ্ঞ। গুলেন ব্যারি সিনড্রোম (জিবিএস) রোগের ক্লিনিক্যাল কারণ, চিকিৎসা সীমাবদ্ধতা ও গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ
গুলেন
ব্যারি সিনড্রোম
(জিবিএস) কি
খুব পুরনো,
নাকি নতুন
রোগ?
জিবিএস
অনেক পুরনো রোগ। একসময় এটাকে ল্যান্ডরে প্যারালাইসিস বলা হতো। ১৮৫৯ সালে ড. ল্যান্ডরে এটাকে ঊর্ধ্বমুখী প্যারালাইসিস হিসেবে অভিহিত করেন। পরবর্তী সময়ে ফরাসি নিউরোলজিস্ট জর্জেস গুলেন এবং জিন অ্যালেকজান্ডার ব্যারের নামানুসারে গুলেন ব্যারি সিনড্রোম হয়। তখনকার দিনে ডায়াগনোসিস যথাযথভাবে হতো না। এখন নিওরোলজি বিভাগ অনেক উন্নত, তাই ডায়াগনোসিস ভালোভাবে হয়। কিন্তু রোগটি পুরনো।
প্রাপ্তবয়স্ক
পুরুষদের মধ্যে
এ রোগে
আক্রান্তের হার
বেশি। এর
কারণ কী?
ডাটাবেজ
অনুসারে দেখা যায়, শিশুদের এ রোগ কম হচ্ছে। কিন্তু এর কারণ জানা যায়নি। তবে যেহেতু এটা অটোইমিউন ডিজিজ, একারণে হয়তো বড়দের তুলনায় ছোটদের কম হয়। যেকোনো বয়সে জিবিএস হতে পারে। তবে সাধারণত ৩০, ৩৫, ৪০ বছর বয়সে একটু বেশি হয় এবং পুরুষদের তুলনামূলক বেশি হয়।
জিবিএস
আক্রান্তদের মধ্যে
পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার
হার কেমন?
জিবিএস
স্নায়ুর একটি অসুখ। এ রোগে আমাদের প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে হাত-পা দুর্বল হয়ে যায়। যখন খুব বেশি দুর্বল হয়ে যায়, নাড়াতে পারে না, তখন আমরা বলি যে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছে। সেটি সাধারণত পা দিয়ে শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশে
এ রোগ
নির্ণয়ের ক্ষেত্রে
সীমাবদ্ধতা কী
কী?
আমাদের
রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি খুব সহজ। খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো প্রয়োজন হয় না। হঠাৎ করে কারো হাতে পায়ে ঝিন ঝিন করা বা একটু জ্বালাপোড়ার মতো হয়, ব্যথা শুরু হয়, একই সঙ্গে তার পা দুর্বল হওয়া শুরু করে, হাঁটাচলা করতে সমস্যা হয়, ধীরে ধীরে হাত-পাগুলো একদম অবশ হয়ে যায়, পা থেকে শুরু হয়ে হাতের দিকে ওঠে, কোনো কোনো সময় কথা বলতে সমস্যা হয়, খাবার গিলতে সমস্যা হয়, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, চোখ বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে সমস্যা হয়। অবস্থার এমন অবনতি যদি খুব দ্রুত এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে হয় তখন নিওরোলজিস্টরা বিভিন্ন নিওরোলজিক্যাল পরীক্ষা করেন রোগীর ওপর। তা থেকে বোঝা যায়। তারপর কিছু পরীক্ষা আছে যেমন মেরুরজ্জু থেকে রস বের করে দেখা হয়। আর কিছু ইলেকট্রোডায়াগনসিস করা হয়। অর্থাৎ নার্ভগুলো টেস্ট করা যায় কম্পিউটারাইজড মেশিনের মাধ্যমে। তবে নিওরোলজিস্ট বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, যাদের এ বিষয়ে জ্ঞান আছে, তাদের দ্বারা কোনো ইনভেস্টিগেশন ফ্যাসিলিটি ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ ক্লিনিক্যালি শনাক্ত করা সম্ভব।
জিবিএসে
আক্রান্ত ব্যক্তির
চিকিৎসায় ভালো
হওয়ার সম্ভাবনা
কতটুকু?
মজার
ব্যাপার হলো অধিকাংশ রোগীই সেলফ রিকভারি করে। তবে যারা খুব দ্রুত আক্রান্ত হয়, হাত-পা খুব দ্রুত অবশ হয়ে যায়, শাসকষ্ট হয়, খাবার গিলতে সমস্যা হয় তাদের আইভিআইজি বা প্লাজমা ফেরেসিস জাতীয় ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। পাঁচ-দশ ভাগ রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা বিকলাঙ্গতা নিয়ে লম্বা জীবন পার করে। আর খুব অল্পসংখ্যক, ৪-৫ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়। তবে এসবই রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে।
পক্ষাঘাতগ্রস্ততা,
শ্বাসকষ্ট, মাংসপেশিতে
ব্যথা—এগুলো
ছাড়া আর
কী কী
সমস্যা জিবিএসে
সৃষ্টি হয়?
এটা
প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রের রোগ। আমাদের তিন ধরনের স্নায়ুতন্ত্র আছে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্র আর স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র। জিবিএস আসলে প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রে হয়। নার্ভগুলোকে আক্রান্ত করে। কোনো কোনো সময় জিবিএস স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীদের খুব উচ্চরক্তচাপ হয়, আবার হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যায়। নাড়ির গতি খুব দ্রুত হতে পারে, কম হতে পারে। শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা হয়। যেহেতু এখানে মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়, ফলে শ্বাস নিতে যে মাংসপেশি আমাদের সাহায্য করে সেগুলো দুর্বল হয়ে পড়লে রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রোগীকে তখন আইসিইউ সাপোর্টে নিতে হয়। কোনো কোনো সময় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে যেসব স্নায়ু বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যায় সেখানে ক্ষতি হতে পারে। তখন রোগীর খাবার গিলতে সমস্যা হয়, কথা জড়িয়ে আসে, খাবার খাদ্যনালির পরিবর্তে ফুসফুসে চলে যায়, নিউমোনিয়া হতে পারে।
জিবিএস
রোগ সৃষ্টির
কারণ (ভাইরাস
ও ব্যাকটেরিয়া)
সম্পর্কে বলুন।
এ রোগ
কি দীর্ঘমেয়াদি?
এ
রোগ হঠাৎ করেই হয় এবং ছয় মাস থেকে এক বছর বা দুই বছরের মধ্যে রিকভার হয়ে যায়। কিছু কিছু রোগী ডিজঅ্যাবিলিটি নিয়েই দীর্ঘ জীবন পার করতে পারে। খুব অল্প ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু হয়। ১৫-২০ শতাংশ রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগে। এটাকে বলে অটোইমিউন ডিজিজ। আমাদের শরীরের একটা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা আছে। সেখানে ধরেন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ঢুকল। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। যা ভাইরাসের ক্ষমতা হ্রাস করে আমাদের সুরক্ষা দেয়। জিবিএসে যেটা দেখা যায় কোনো একটা ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি বা ফুসফুসের সংক্রমণ ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়া দিয়ে হয়ে যায়। তার থেকে এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পরে জিবিএস রোগ শুরু হয়। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আমার ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি বা নিউমোনিয়া করেছিল। সেই সংক্রমণ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু এই ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার চেহারার সঙ্গে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের কাভারিং বা মাইলিন সিথের অনেকটা মিল রয়েছে। তাই ওই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডিটা তৈরি হয়েছিল সে স্নায়ুতন্ত্রের কাভারিংকে মনে করে শত্রু। সে গিয়ে ওটাকে অ্যাটাক করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমার শরীরকেই আক্রমণ করছে, সেটাকেই বলা হচ্ছে অটো ইমিউন। ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এখানে পরোক্ষভাবে দায়ী। সেখানে দুটির মধ্যে বাহ্যিক সাদৃশ্য থাকায় রোগীর প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজ অঙ্গকে আক্রান্ত করে।
দেশে
এ রোগের
ঝুঁকি আগের
তুলনায় কি
বেড়েছে?
জিবিএস
নিয়ে গবেষণা চলছে। কেন জিবিএস হয় তার শতভাগ উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, সার্জারি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেশনের পরে জিবিএস হয়। এখন ডেঙ্গু, করোনা, জিকা ভাইরাসের পরে জিবিএস হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে যে ব্যাকটেরিয়াটা বেশি দায়ী সেটা হলো ক্যাম্পাইলোব্যাকটার।
জিবিএস
নিয়ে বাংলাদেশে
চিকিৎসা ও
গবেষণা সীমাবদ্ধতা
রয়েছে কিনা?
এ
রোগে চিকিৎসা পদ্ধতি দুটি। এক. ইমিউনোগ্লোবিউলিন, দুই. প্লাজমা ফেরেসিস। দুটি চিকিৎসাই ব্যয়বহুল। ইমিউনোগ্লোবিউলিন চিকিৎসায় ৫ দিনে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা দরকার হয়। প্লাজমা ফেরেসিস হয়তো ১ থেকে ২ লাখ টাকায় হবে। আবার আইসিইউ দরকার হলেও তা সহজলভ্য নয়। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লে পরবর্তী চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপির সুবিধাও হয়তো রোগী পাচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জিবিএসের নতুন একটা ওষুধ ট্রায়াল পর্যায়ে আছে।
জিবিএস
নিয়ে জনসাধারণের
মধ্যে জানাশোনা
কম থাকার
কারণ কী?
জিবিএস নিয়ে আমাদের দেশে এখনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বিশ্বে সাধারণত এই রোগে প্রতি লাখে ১ অথবা ২ জন আক্রান্ত হয়। এটা খুব যে সাধারণ রোগ তা নয়, তাই হয়তো সচেতনতা নেই। কিন্তু সচেতনতার দরকার আছে। রোগীর যদি হঠাৎ হাত-পা দুর্বল হতে থাকে বা বাড়তে থাকে তাহলে অবশ্যই নিউরোলজিস্ট বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।