অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স গড়ে ওঠায় চিকিৎসা কঠিন হচ্ছে

প্রকাশ: ডিসেম্বর ২৬, ২০২২

অধ্যাপক ডা. এম ফয়েজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনা, গবেষণা চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিনির্ধারক ছিলেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। কাজ করেছেন মাঠ পর্যায়েও। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) গড়ে ওঠা, এএমআরের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধতার বিষয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলুন।

যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক পরজীবী সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ঘটে। জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হওয়ার ফলে অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে সংক্রমণের চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে রোগের বিস্তার, গুরুতর অসুস্থতা মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। দ্য ল্যানসেটের বিশ্লেষণে ২০১৯ সালে এএমআরের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০ লাখ মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিষয়টিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্যের জন্য শীর্ষ হুমকিগুলোর একটি হিসেবে অভিহিত করছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এএমআর একটি মহামারী সুনামি।

এএমআর কীভাবে গড়ে ওঠে?

ব্যাকটেরিয়া ছত্রাকের মতো জীবাণু যখন তাদের ধ্বংস করার জন্য ডিজাইন করা ওষুধগুলোকে পরাস্ত করার ক্ষমতা অর্জন করে তখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ ঘটে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টিফাঙ্গালের সংস্পর্শে থাকা জীবাণুর সংমিশ্রণ এবং সেই জীবাণুর বিস্তার তাদের প্রতিরোধের প্রক্রিয়া দ্বারা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত জেনেটিক (বংশগতি) পরিবর্তনের মাধ্যমে এএমআর স্বাভাবিকভাবেই ঘটে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধী জীবাণুগুলো মানুষ, প্রাণী, খাদ্য, গাছপালা পরিবেশের পানি, মাটি বাতাসে পাওয়া যায়। এগুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে বা মানুষ প্রাণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যার মধ্যে প্রাণিজ উেসর খাবারও রয়েছে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের প্রধান চালকের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালগুলোর অপব্যবহার এবং অতিরিক্ত ব্যবহার; মানুষ প্রাণী উভয়ের জন্য পরিষ্কার পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি সুবিধার অভাব; স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা খামারগুলোয় দুর্বল সংক্রমণ এবং রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ; গুণমান, সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ, ভ্যাকসিন ডায়াগনস্টিকগুলোয় দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থা; সচেতনতা জ্ঞানের অভাব; আইনের প্রয়োগের অভাব।

এএমআর প্রতিরোধে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র কেমন হওয়া উচিত?

অ্যান্টিবায়োটিকগুলো নির্ধারিত সঠিকভাবে বিতরণ করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ চিকিৎসা প্রেসক্রিপশন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। ক্লিনিক্যাল সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে দ্রুত পয়েন্ট-অব-কেয়ার ডায়াগনস্টিক (যে পরীক্ষাগুলো রোগীর সেবা গ্রহণের স্থানে তাত্ক্ষণিক করা হয়) ব্যবহার করে যদি তাতে অপ্রয়োজনীয় অপর্যাপ্ততা থাকে তাহলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রোগীদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যেমন ভ্যাকসিন ব্যবহার করা যেতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক সংগ্রহের সিদ্ধান্তে পরিবেশগত মানদণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে রুটিন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ছাড়াই উৎপাদিত খাবার ক্রয়ের নীতির পরিবর্তন করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা-সম্পর্কিত সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হাসপাতালে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। কার্যকরভাবে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং জীবাণু অপসারণের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল থেরাপির সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকি সম্পর্কে রোগীকে পরামর্শ দিয়ে সম্ভব হলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ব্যবহার করতে হবে। অব্যবহূত মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ নষ্ট করা বা ফেরত নেয়ার নিরাপদ, প্রস্তাবিত পদ্ধতি সম্পর্কে রোগীদের জানাতে হবে।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, চিকিৎসার শুরুতেই চতুর্থ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিষয়টি কি এএমআর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রভাবক হচ্ছে?

সঠিকভাবে সংক্রমণ ওষুধ নির্ণয় করার উত্তম পন্থা হলো গুণগত মানের মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব। এর অভাবে শুরুতেই ধরনের ওষুধ প্রয়োগের ঘটনা ঘটতে পারে। ল্যাব নজরদারি ব্যবস্থা কার্যকর জোরদার করা গেলে প্রথমেই নতুন প্রজন্মের ওষুধ ব্যবহার কম হতো।

চতুর্থ প্রজন্মের ওষুধের ক্ষেত্রেও এএমআর গড়ে উঠেছে, সেক্ষেত্রে করণীয় কী?

ধরনের ওষুধ কেবল সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা।

এএমআরের ক্ষেত্রে চিকিৎসক নাকি রোগী কার দায় বেশি?

উন্নত রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কমে যায়।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এএমআরের ব্যাপকতা কেমন?

অনেক দেশেই ওভার-দ্য-কাউন্টার বা ওটিসি (ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ বিক্রয়) ওষুধ হিসেবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অনানুষ্ঠানিক খাতে অযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জড়িত একটি বহুত্ববাদী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপস্থিতি পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর আক্রমণাত্মক অনৈতিক বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিষয়টি আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। এই বিশাল বাজারের তদারকি করার জন্য মানবিক, প্রযুক্তিগত নজরদারি-আইনগত ক্ষমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালগুলোর উপযুক্ত যৌক্তিক ব্যবহারের নীতি এবং বিধান এএমআরের বিকাশ বিস্তারকে বাধা দেয়ার জন্য কার্যকর হবে।

এএমআরের বিষয়ে চিকিৎসক হিসেবে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা কী দেখছেন?

ওষুধ প্রতিরোধী প্যাথোজেনগুলোর উত্থান এবং বিস্তার জীবাণু প্রতিরোধের প্রক্রিয়া অর্জন করেছে, যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের দিকে পরিচালিত করে। সাধারণ সংক্রমণের চিকিৎসা করার আমাদের ক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বিশেষ করে উদ্বেগজনক হলো মাল্টি এবং প্যান প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার (সুপার বাগ নামে পরিচিত) দ্রুত বিশ্বব্যাপী বিস্তার, যার চিকিৎসা অ্যান্টিবায়োটিকের মতো বিদ্যমান অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ দিয়ে করা যায় না। নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ উত্পন্নের ক্রমধারা গতিহীন। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্টে ৩২টি অ্যান্টিবায়োটিক শনাক্ত করেছে, যা প্যাথোজেনের (রোগের সংক্রমণ  বা জীবাণু উত্পন্ন হতে সহযোগী) গতিকে ত্বরান্বিত করে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ক্রমবর্ধমান হারে অকার্যকর হয়ে উঠছে কারণ ওষুধ প্রতিরোধ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এতে সংক্রমণ মৃত্যুর চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে উঠছে। যদি মানুষ এখন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পদ্ধতি পরিবর্তন না করে তাহলে নতুন অ্যান্টিবায়োটিকগুলো বর্তমানের মতো একই পরিণতি ভোগ করবে অকার্যকর হয়ে পড়বে।

এএমআর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। তবে নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম শুরু হয়েছে কিনা?

২০১৫ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬৮তম অধিবেশনে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধের ওপর গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান (জিএপি) গৃহীত হয়েছে। সব দেশকে তাদের নিজস্ব জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই অনুযায়ী জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশে ২০১৭-২০২২ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কন্টেইনমেন্ট (দমন) প্রস্তুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের বিষয়ে নজরদারি পরিচালনা করছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরবর্তী সময়ে আইইডিসিআরকে এএমআর নজরদারির জন্য জাতীয় রেফারেন্স ল্যাবরেটরি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। জাতীয় অর্থনীতি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য এএমআরের খরচ তাত্পর্যপূর্ণ। কারণ এটি রোগীদের হাসপাতালে থাকার সময়কাল দীর্ঘ করে, চিকিৎসার ব্যয় বাড়ায় এবং নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে। ওষুধ প্রতিরোধী সংক্রমণ প্রতিরোধ পর্যাপ্ত চিকিৎসার জন্য কার্যকর সরঞ্জাম, বিদ্যমান এবং নতুন গুণমান নিশ্চিত করা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের যৌক্তিক ব্যবহার ছাড়া যাদের চিকিৎসা ব্যর্থ হচ্ছে বা সংক্রমণে মারা যাচ্ছে তাদের সংখ্যা বাড়বে। তাতে করে সিজারিয়ান বা হিপ জয়েন্ট প্রতিস্থাপন, ক্যান্সার কেমোথেরাপি এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ সার্জারির মতো চিকিৎসাগুলো আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫