অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স

এএমআর ও ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রকাশ: ডিসেম্বর ২৬, ২০২২

আমরা অতি ক্ষুদ্র জীবকে অণুজীব বা জীবাণু বলি। ইংরেজিতে বলা হয় মাইক্রোবস। এদের দেখতে মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্র প্রয়োজন হয়। সব জীবাণু রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করে না। যেসব জীবাণু রোগ সৃষ্টি করে, তাদের প্যাথোজেনিক বা রোগজনক বা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বলা হয়। আমাদের পরিবেশে অনেক ধরনের জীবাণু আছে। এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া প্রধান রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। জীবাণুর বংশ বৃদ্ধির জন্য পোষক বা হোস্ট প্রয়োজন হয়। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী বা উদ্ভিদকে এরা হোস্ট বা পোষক হিসেবে ব্যবহার করে।

জীবাণু যখন আমাদের দেহে প্রবেশ করে, আক্রমণ করে, সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং কোষের ক্ষতিসাধন করে, তখন সংক্রমণ বা ইনফেকশন হয়। জীবাণুর সংক্রমণ চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহূত হয়, সেগুলোকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বা জীবাণু নিরোধক ওষুধ বলা হয়। এসব ওষুধ জীবাণুকে মেরে ফেলে অথবা জীবাণুর বংশবৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। যেসব ওষুধ ব্যাকটেরিয়া নামক জীবাণুর বংশবৃদ্ধি বন্ধ করে বা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে তাদের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ড্রাগস বা ব্যাকটেরিয়া নিরোধক বলা হয়। সাধারণত এগুলোকে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক নামে জানি। একইভাবে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভাইরাস নিরোধক (অ্যান্টিভাইরাল), ছত্রাকের বিরুদ্ধে ছত্রাক নিরোধক (অ্যান্টিফাঙ্গাল) ওষুধ ব্যবহূত হয়।

রোগ সৃষ্টিকারী অসংখ্য জীবাণু এসব জীবাণু নিরোধক বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বা এএমআর বলা হয়। অর্থাৎ যেসব ওষুধ আগে যে ধরনের জীবাণুকে বিনাশ করতে পারত, সেসব জীবাণু এখন আগের ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা বা এএমআর অর্জন করেছে। সংক্রামক চিকিৎসায় অনেক ওষুধ আর কাজ করছে না। ফলে বিশ্বব্যাপী জীবাণু সংক্রমণজনিত রোগে মৃত্যুহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অ্যান্টিব্যাকটেরিয়ালসের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া নামক জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা বা রেজিস্ট্যান্স সবচেয়ে ব্যাপক। সময়ের বহুল ব্যবহূত কার্যকর পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিকস এখন আর কার্যকরী নয়। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত রোগে ব্যবহূত সব গ্রুপের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ড্রাগের বিরুদ্ধেই অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া রেজিস্ট্যান্স তৈরি করেছে। কোনো কোনো ব্যাকটেরিয়া মাল্টিড্রাগ বা এক্সটেনসিভ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স তৈরি করেছে। অতিসম্প্রতি দেখা গেছে, কিছু ব্যাকটেরিয়াল স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ড্রাগই কার্যকর নয়। ব্যাকটেরিয়ার ধরনের প্রতিরোধী ক্ষমতাকে প্যান ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বা টোটালি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। যেসব ব্যাকটেরিয়া একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ্যতা অর্জন করেছে, সেগুলোকে সুপার বাগ বলা হয়।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ওপর বিশ্বের ২০৪টি দেশে গবেষণা পরিচালনা করে। যার ফলাফল ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। এতে, ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ২০১৯ সালে প্রায় ১২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ওই সময়কালে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এএমআরের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য রোগে মারা যায়। দরিদ্র দেশগুলোতে যা ছিল ব্যাপক ভয়াবহ।

২০১৬ সালে বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক সার্ভিল্যান্স কর্মসূচি চালু হয়। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ধরন বিস্তার নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রদান করে। সেই রিপোর্টে বাংলাদেশে এএমআর ব্যাপকতা অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয় কোন কোন ক্ষেত্রে ৩১-৬৭ শতাংশ জীবাণু মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স। এর অর্থ দাঁড়ায় প্রায় সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। আইইডিসিআরের এক গবেষণায় দেখানো হয় যে দেশে বহুল ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্তত ১৭টির ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যক্ষমতা কমে গেছে। চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ।

দেশে উচ্চমাত্রায় এএমআর বৃদ্ধির কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো . সংক্রামক রোগ, এর ধরন চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা, . হাসপাতালের সার্বিক পরিবেশ সংক্রমণ বিস্তারে বড় সহায়ক, . অপ্রয়োজনীয় বা একাধিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ওষুধ এক সঙ্গে প্রয়োগ, . কী কারণে কোন অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ওষুধ দেয়া হলো তার রেকর্ড না থাকা এবং বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং না থাকা, . খুচরা পর্যায়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ নজরদারি না থাকা, . ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ, . পর্যাপ্ত মাত্রায় সময়কাল ধরে অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ সেবন না করা অথবা অল্প মাত্রায় প্রয়োগ করা ইত্যাদি, . ভাইরাসজনিত রোগে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া, . পশুপাখির খাবারে অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা, ১০. কমিউনিটি ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট না থাকা, ১১. রিটেল ফার্মেসিগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদানসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ না করা ইত্যাদি।

. মো. আবদুল মজিদ

অধ্যাপক, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫