শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ

শীতে শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে

প্রকাশ: ডিসেম্বর ১৯, ২০২২

বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্ব প্রতিনিয়ত নগরায়ণ শিল্পায়নের পথে হাঁটছে। উন্নয়নের পথে বলি হচ্ছে মানুষের সুস্বাস্থ্য, বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্র। দিনে দিনে ফুসফুস শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বাড়ছে। তাছাড়া শীতকাল একটি শুষ্ক মৌসুম। ঠান্ডা তাপমাত্রার এই দিনগুলোয় আর্দ্রতা খুবই কমে যায়। ফলে সময়ে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়ে। পাশাপাশি ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও বাড়ে।

শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বলতে কী বোঝায়?

শ্বাসনালির সংক্রমণ বলতে শ্বাসনালির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন রোগকে বোঝায়। ধরনের সংক্রমণকে সাধারণত উচ্চ বা নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। বাইরে থেকে জীবাণুর (যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ইত্যাদি) প্রবেশ যেমন সংক্রমণ ঘটায়, তেমনি পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের কারণেও বিভিন্ন রোগ তৈরি হতে পারে।

উচ্চ শ্বাসতন্ত্র: উচ্চ শ্বাসতন্ত্র বলতে নাক থেকে স্বরযন্ত্র (ল্যারিংস) বোঝায়। এখানে সংক্রমণের মধ্যে টনসিলাইটিস, ফ্যারিনজাইটিস, ল্যারিনজাইটিস, সাইনোসাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি ইত্যাদি অন্যতম। সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, টনসিলে প্রদাহ, সাইনাসে সংক্রমণ প্রদাহ, গলা ভাঙা ইত্যাদি উচ্চ শ্বাসতন্ত্রের রোগের উপসর্গ। 

নিম্ন শ্বাসতন্ত্র: শ্বাসনালি (ট্রাকিয়া) থেকে ফুসফুস পর্যন্ত অংশকে নিম্ন শ্বাসনালি বোঝায়। শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, কাশি, বুকে ব্যথা এবং ফ্লেম বা শ্লেষ্মার সঙ্গে রক্তপাত ইত্যাদি লক্ষণ নির্দেশ করে যে ফুসফুস শ্বাসতন্ত্রের কোনো রোগ বিদ্যমান। নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ উচ্চ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর রোগ জটিলতা তৈরি করে।

কারণ

- জীবাণু

- ধূমপান মাদকদ্রব্য গ্রহণ

- বিশ্রামহীন জীবনযাপন

- অপুষ্টি

- অতিরিক্ত ইসাইক্লিক ওষুধ গ্রহণ

জীবাণু: ফুসফুসের বেশির ভাগ জীবাণুঘটিত সংক্রমণ কাশি, হাঁচি, মুখ নিঃসৃত ড্রপলেটের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

ধূমপান: ফুসফুসে অসুখ বা অন্যান্য সমস্যা হওয়ার অন্যতম কারণ ধূমপান। অধূমপায়ীর তুলনায় ধূমপায়ীদের ফুসফুসে নানা সমস্যা হয়। শুধু তা- নয়, ধূমপানের কারণে ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা ১০ থেকে ৩০ গুণ বেশি। ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য ধূমপানকে দায়ী করা হয়।

বায়ুদূষণ: বায়ুদূষণ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের একটা বড় মাধ্যম। বায়ুতে স্বাভাবিক অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে ২১ শতাংশ। যদি কোনো কারণে এর ঘাটতি হয়ে অন্য গ্যাসের ঘনত্ব বা বালুকণার পরিমাণ বেড়ে যায়, তবেই তাকে দূষিত বায়ু বলে। আর সেই বায়ু গ্রহণের ফলে অনেকেই ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ফুসফুসের ক্যান্সারের মৃত্যুর শতাংশ বায়ুদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়া হাঁপানি (অ্যাজমা) রোগ বৃদ্ধি করে, বিভিন্ন রকম বাতাসে ভাসমান কণা ফুসফুসে জমা হয়ে জটিল রোগ তৈরি করে। পাশাপাশি এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমতে থাকে বিধায় দূষিত এলাকার মানুষ জীবাণুর আক্রমণে বেশি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে জীবাণুর সংক্রমণ পরিবেশ দূষণ বেশি।

বংশগত: পরিবারের কোনো সদস্য ফুসফুসসংক্রান্ত কোনো রোগ বা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে অন্যদেরও ঝুঁকি থাকে; এমনকি যাদের মা-বাবা বা ভাই-বোন ফুসফুসের সমস্যায় আক্রান্ত, তারা নিজেরা ধূমপান না করলেও রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

রাসায়নিক সামগ্রী ব্যবহার: বিভিন্ন  রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার বিভিন্ন রকম শ্বাসতন্ত্রের রোগের প্রত্যক্ষ কারণ।

খাদ্যাভ্যাস: কিছু খাবারকে দায়ী করা হয় ফুসফুসের জটিলতার জন্য। যেমন অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার।

রোগের লক্ষণ

- কাশি

- শ্বাসকষ্ট

- শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শব্দ হতে পারে

- শারীরিক দুর্বলতা

- ঘন ঘন প্রস্রাব

- পায়ের গোড়ালি বা পা ফুলে যাওয়া

- অস্বাভাবিক ঘুম

শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণঘটিত প্রধান রোগ

সিওপিডি: বিশ্বের তৃতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ সিওপিডি বা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট। ৮০-৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ধূমপান ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করে। এর বাইরে রয়েছে ধুলাবালি ঠান্ডা। শিল্পবর্জ্য ধোঁয়া শ্বাসনালিতে ধরনের রোগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বংশগতভাবে প্রাপ্ত, জন্মগত ত্রুটি এবং বয়সও গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুস দুর্বল হতে থাকে।

অ্যাজমা: হাঁপানি বা অ্যাজমা একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যার মূল লক্ষণ হলো শ্বাসকষ্ট শাঁ শাঁ শব্দে নিশ্বাস ফেলা। বংশগত কারণে আগে বেশি হলেও ইদানীং অ্যালার্জি, তামাকের ধোঁয়া রাসায়নিক উত্তেজক পদার্থ হাঁপানির মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। অ্যাজমা বা হাঁপানি কারো একবার হলে পুরোপুরি নিরাময় হয় না; কিন্তু যথাযথ চিকিৎসাসহ নিয়ম মানলে রোগটি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে এনে জীবনযাপন করা সম্ভব।

যক্ষ্মা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যক্ষ্মাবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি। এটি ছোঁয়াচে রোগ বলে যক্ষ্মায় আক্রান্ত একজন রোগী আরো ১০ জনকে আক্রান্ত করতে পারে।

কভিড-১৯ অন্যান্য নিউমোনিয়া: করোনাভাইরাসজনিত সংক্রমণে কভিড-১৯-এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ফুসফুস। শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে ভাইরাসের সংক্রমণ।

ফুসফুসের কোষগুলোতে এই ভাইরাস বাসা বাঁধে এবং সেখানেই প্রসার ঘটায়।

ক্যান্সার: বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে শীর্ষস্থানে ফুসফুসের ক্যান্সার। ৮৫-৯০ ভাগ ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্যই দায়ী তামাকের ব্যবহার বা ধূমপান। তাই রোগে পুরুষদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। এজন্য একটু সচেতন হলেই এসব সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

প্রতিরোধ সচেতনতা

ঘরের বাইরে বের হলে মাস্ক পরুন। এতে শুধু জীবাণু নয়, বায়ুদূষণ থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

হাঁচি বা কাশির সময় কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢাকুন।

বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন। খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। সাবান না থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন।

অন্যের সঙ্গে হাত মেলানো বা হ্যান্ডশেক এড়িয়ে চলুন। এক মানুষের হাত থেকে অন্য মানুষের হাতে রোগ ছড়ায়। যেখানে-সেখানে স্পর্শ করবেন না।

যেখানে-সেখানে কফ-থুতু ফেলা বন্ধ করুন। ব্যবহারের পর টিস্যু বদ্ধ ডাস্টবিনে ফেলুন। রুমাল ধুয়ে ফেলুন। ব্যবহার করা মাস্কও যত্রতত্র না ফেলে ডাস্টবিনে ফেলুন।

খোলামেলা আবহাওয়ায় থাকার চেষ্টা করুন। ঘরের ভেতর প্রচুর আলো-বাতাসের প্রবাহের ব্যবস্থা করুন।

যক্ষ্মা, করোনা ইত্যাদির সংক্রমণ প্রতিরোধে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাই দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন ডায়াবেটিস, হূদরোগ, কিডনির সমস্যার যথাযথ চিকিৎসা নিন। চল্লিশোর্ধ্ব বয়স হলে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন চেকআপ করুন। পুষ্টিকর খাবার খান। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখুন।

তামাক ধূমপান বর্জন করুন। ধূমপায়ীদের ফুসফুসের শিরা নালিতে অতি দ্রুত বর্জ্য জমে যায়। কারণে বাতাসের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। গর্ভাবস্থায় ধূমপান বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দেয়। তামাক সিগারেট, জর্দা, গুল, সাদা পাতা যেভাবেই নেয়া হোক না কেন এটা প্রাণঘাতী।

পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে। বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে।

রাস্তার ওপরই দিনের পর দিন মাটি বর্জ্য ফেলে না রেখে যতটা সম্ভব দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে।

 

ডা. সাদিয়া সুলতানা রেশমা

বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ

ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কভিড-১৯ হাসপাতাল, ঢাকা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫