বিশ্ববাজারে গ্যাসের দামে ঊর্ধ্বগতি

এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতা ব্যবহারে পিছিয়ে বাংলাদেশ

প্রকাশ: ডিসেম্বর ১২, ২০২২

আবু তাহের

বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) অস্বাভাবিক দাম থাকায় এলএনজি টার্মিনালের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি এশিয়ার অনেক দেশ। এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতা অব্যবহূত হওয়ার তালিকায় সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে বাংলাদেশ। এলএনজির রিগ্যাসিফিকেশনে মোট সক্ষমতার ৫০ শতাংশেরও বেশি অব্যবহূত আছে।

এশিয়ার এলএনজি টার্মিনাল অবকাঠামো অব্যবহূত থাকা নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আইএইচএস মার্কিট-এর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জ্বালানির আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যাশিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বৃহৎ এলএনজি আমদানিকারকদের মধ্যে চীন, ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে আমদানি বিবেচনায় এলএনজি অবকাঠামো সবচেয়ে বেশি অব্যবহূত থেকেছে বাংলাদেশে।

আইএইচএস মার্কিট ২০২২ সালের প্রকাশিত তৃতীয় প্রান্তিকে এলএনজি অবকাঠামো ব্যবহারের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। সেখানে মোট চারটি দেশের ২০২১ ২০২২ সালে এলএনজি টার্মিনালের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে বাংলাদেশ এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতার ৫০ শতাংশও ব্যবহার করতে পারেনি। ২০২১ সালে এলএনজি সরবরাহে টার্মিনাল ব্যবহার হয়েছিল ৭৫ শতাংশের কাছাকাছি। বছর ২৫ শতাংশের বেশি কমে গিয়ে তা ৫০ শতাংশের নিচে নেমেছে।

ভারতের সবচেয়ে বেশি এলএনজি টার্মিনাল অবকাঠামো অব্যবহূত থাকলেও গত বছরের অনুপাত বিবেচনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অব্যবহূত থেকেছে। টার্মিনালের সক্ষমতা কম ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া যায় পেট্রোবাংলার চলতি বছরের এলএনজি সরবরাহচিত্রে। চলতি বছরের জুলাই থেকে স্পট এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। ফলে সময় থেকে জাতীয় গ্রিডে ১৫০-২০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ কমে গিয়েছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি উৎস থেকেও কার্গো সরবরাহ কমে যায় চলতি বছর।

পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত জাতীয় গ্যাস গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ হয়েছে ৪৫০-৫০০ এমএমসিএফডি, এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭৫০-৮০০ আর আগস্ট থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়ে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে।

জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহ বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, গত ১২ মাসে গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ গড়ে দৈনিক ৫৭০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো ছিল। বাকি ৪৩০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি ক্যাপাসিটি বসে ছিল।

জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান অবকাঠামোয় এলএনজি সরবরাহ দেয়া যাচ্ছে না, কারণ উচ্চমূল্য এবং এটি যেকোনো সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি হতে পারে, সে পূর্বাভাসও ছিল। ফলে অবকাঠামোগুলো অব্যবহূত থাকবে এটিই স্বাভাবিক।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, এলএনজি অবকাঠামো ব্যবহার করা যাবে না এটিই তো স্বাভাবিক। কারণ সক্ষমতা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করা যায়নি। বিশ্ববাজারে এলএনজির অস্বাভাবিক দাম। দাম বাড়লে আমদানি করার মতো টাকা থাকতে হবে তো? সেটি নেই। ফলে এলএনজির বিদ্যমান যে অবকাঠামো তা ব্যবহার করা না গেলেও খরচ কিন্তু কমেনি। কারণ সক্ষমতা বসে থাকলেও তার ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই দিতে হয়েছে পেট্রোবাংলাকে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে ধরনের আর্থিক ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হতো।

এলএনজি সরবরাহ চুক্তি অনুযায়ী, মোট সক্ষমতার এলএনজি সরবরাহ দিতে না পারলেও পেট্রোবাংলাকে অব্যবহূত সক্ষমতার জন্য সংশ্লিষ্ট টার্মিনাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়।

দেশে আমদানীকৃত গ্যাস সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। দৈনিক এক হাজার এমএমসিএফ সক্ষমতার দুটি ভাসমান টার্মিনালের একটির মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেটেড এনার্জি অন্যটির মালিকানা সামিটের।

খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, দুটি টার্মিনালের মোট সক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করা যাচ্ছে না এলএনজি আমদানি সংকটে। বিশেষত চলতি বছরের জুলাই থেকে স্পট এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় ৫৫০-৬০০ এমএমসিএফডির বেশি এলএনজি সরবরাহ হয়নি।

এলএনজি টার্মিনাল সক্ষমতার বিষয়টি পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভর করে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য, তখনই পুরো ক্যাপাসিটি ব্যবহার করা যাবে যখন ওই সক্ষমতার গ্যাস আমদানি করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেটি করা না গেলে তো সক্ষমতা বসিয়েই রাখতে হবে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চমূল্যের কারণে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। দাম সহনীয় পর্যায়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছে পেট্রোবাংলা।

এলএনজি টার্মিনাল অব্যবহূত থাকলে তার ক্যাপাসিটি চার্জের কী হবে জানতে চাইলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এটি ক্যাপাসিটি চার্জ নয়, এটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণকারী কোম্পানির বিনিয়োগ। গ্যাস রিগ্যাসিফিকেশনের সঙ্গে চার্জ তারা তুলে নেয়। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ অনুযায়ী অর্থ তাদের দিতেই হবে।

বিশ্ববাজারে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ সরকার দশমিক গিগাওয়াট এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং টার্মিনাল নির্মাণ থেকে সরে এসেছে বলে আইইইএফএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে আরো জানিয়েছে, বাংলাদেশ পাকিস্তান অতিমাত্রায় এলএনজি-নির্ভরতা বাড়ানোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেশনিং করতে বাধ্য হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহে রেশনিং করতে গিয়ে শিল্প খাতে তীব্র গ্যাস সংকটের পাশাপাশি ব্ল্যাকআউটের মতো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে বলে আইইইএফএর বিশ্লেষণে উঠে আসে।

বৈশ্বিক বাজারদরে জ্বালানি সংস্থান করতে গিয়ে রিজার্ভ সংকটের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস বিদ্যুত্সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের গভীরে নিমজ্জিত হয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী এলএনজির বাজারদরে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিশেষত ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ কমে গেলে বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি সংগ্রহে ইউরোপীয় দেশগুলো তীব্র প্রতিযোগিতায় নামে। এরই প্রেক্ষাপটে পণ্যটির দর বেড়ে যায়। বিশেষ করে এশিয়ার আমদানিকারক দেশগুলোয় এলএনজি সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় খোলাবাজারে পণ্যটির দাম আকাশচুম্বী হয়। যদিও এখন তা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে।

এলএনজির ঊর্ধ্বমুখী দরে টিকতে না পেরে এশিয়ার অনেক দেশ বাজার থেকে ছিটকে পড়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে এলএনজির দাম ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানায় আইইইএফএ।

জ্বালানি আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর এশিয়ার বৃহৎ আমদানিকারক দেশ চীন ভারতে যথাক্রমে ২১ ১৮ শতাংশ আমদানি কমে গিয়েছে। প্রভাবের রেশ ধরে বাংলাদেশ পাকিস্তানে যথাক্রমে ১৫ ১৬ শতাংশ এলএনজি আমদানি কমে।

বিশ্ববাজারে গ্যাসের ঊর্ধ্বমুখী দামের প্রভাবের আগে এশিয়ার বাজারে ৪৯০ বিলিয়ন ডলারের এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণ প্রস্তাব ছিল। কিন্তু উচ্চমূল্যে পণ্যটির আমদানি সংগ্রহ কমে যাওয়ায় এখন বিনিয়োগ কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫