ট্যাপেস্ট্রি গুরু রশিদ চৌধুরী

প্রকাশ: নভেম্বর ৩০, ২০২২

ওয়াহিদ সুজন

রশিদ চৌধুরী। বাংলাদেশে আর্ট ফর্ম ট্যাপেস্ট্রি বা তাপিশ্রী নিয়ে আলোচনার অভিমুখ মোটামুটি এই নামে এসে স্থির হয়। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া-পরবর্তী পর্বে পূর্ব বাংলার শিল্প আন্দোলন ছিল স্থানীয় ভাবনির্ভর নতুন সম্ভাবনামুখী। জন্মভূমিকে নতুনভাবে আবিষ্কারে মশগুল হলেন শিল্পীরা। ব্যতিক্রম বাদেই ওই সময়ের শিল্পকর্মে বাংলার আবহমান রূপ শিল্পের সঙ্গে বৈশ্বিক যোগ লক্ষ করা যায়। সেই কারিগরদের একজন রশিদ চৌধুরী। নিরীক্ষা দীর্ঘ শিল্পভ্রমণের মাধ্যমে ট্যাপেস্ট্রিকে বেছে নেন তিনি।

ট্যাপেস্ট্রিকে স্রেফ মাধ্যম আকারে নয়, শিল্পীর পারিপার্শ্বিক চেতনা থেকেও আলাদা করা যায় না। একজন শিল্পী সমাজের সঙ্গে তার যাপনের সম্পর্ক কোনো সূত্র নিয়ে জোড়া দেন বা সমাজ কীভাবে তাকে প্রভাবিত করে সেই উত্তরও মেলে। রশিদ চৌধুরী পাশ্চাত্যের সর্বাধুনিক টেকনিকের মধ্যে দেখেছেন ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গ উপস্থাপনার সম্ভাবনা। শিল্পের বৈশ্বিক রূপটি তার অজ্ঞাত ছিল না। উপকরণের সহজলভ্যতা ভাব প্রকাশে উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে একটি সাধারণ সূত্র আয়ত্তে নিয়ে আসেন তিনি।

সেদিক থেকে ট্যাপেস্ট্রিকে স্রেফ চমক বা নতুন আঙ্গিক হিসেবে দেখলে চলে না। রশিদ চৌধুরীর শিক্ষার একটা অংশজুড়ে ছিল পাশ্চাতের দুই শিল্প শহর প্যারিস মাদ্রিদ; যেখানে দুনিয়ার নানা প্রান্তের শিল্পী দুধারি তালোয়ার হিসেবে হাজির হন। একদিকে তারা নতুন দুনিয়া কাটাছেঁড়া করেন, অন্যদিকে সেই ক্ষত বুজিয়ে দেন নিজের ঐতিহ্য দিয়ে। শহরগুলো বুর্জোয়া বিকাশের চূড়ান্ত দশা দেখছে তখন। সামন্তবাদের প্রবল দ্বন্দ্বের পর সমাজে ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে এর মধ্যে। দুনিয়া কখনো আগের মতো থাকে না, তখন সেই প্রক্রিয়া যেন আরো দ্রুতলয়ে গড়াচ্ছে। এই ব্যক্তি বিশেষ হলেও তার প্রকাশ বির্মূত। প্রায়ই তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত অঞ্চল থেকে আসা রশিদও নিজের মাধ্যমটি খুঁজে পেলেন এমন টানাপড়নে। সেখানে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আঞ্চলিক অভিজ্ঞান মিলিয়ে পড়েন তিনি। ব্যক্তির বির্মূত রূপটি ঠাঁই পাচ্ছে নান্দনিক ফর্মে। ট্যাপেস্ট্রি সেই কাজটি করছে।

রশিদ চৌধুরী এভাবে বর্ণিত হন যে তার হাত ধরেই উপমহাদেশ ট্যাপেস্ট্রির নবযুগের সূচনা। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠায় ট্যাপেস্ট্রির ঢঙ তার কাছে অপরিচিত ছিল না। শুরুতে সুতা পাটকে বেছে নেন তিনি, পরবর্তীকালে এর সঙ্গে রেশম ব্যবহার করে ঐতিহ্যবাহী তাঁতের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। আবহমান সুচিকর্ম ধাঁচের শিল্পকর্মে আধুনিক ব্যক্তিত্বের মনোজগৎ উঠে আসে স্বমহিমায়. যাকে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য কোথাও চিনতে ভুল হয় না।

রশিদ চৌধুরীর জন্ম ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ফরিদপুরের (বর্তমান রাজবাড়ী) রতনদিয়া গ্রামে, এক জমিদার পরিবারে। হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির পাশাপাশি আদিবাসী লোকশিল্পের ঐতিহ্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন তিনি। ঢাকা আর্ট কলেজে চিত্রকলায় তার প্রাথমিক শিক্ষা। ওই সময় সবাই যেভাবে শুরু করেন তেল, জলরঙ, গুয়াশ বা টেম্পেরায় মনোনিবেশ করেন তিনি।

ততদিনে অঞ্চল কাগজে-কলমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দশা অতিক্রম করেছে। পূর্ববঙ্গের সামনে নতুন দেশ আত্মপরিচয় তৈরির নতুন চ্যালেঞ্জ, যে চ্যালেঞ্জ রশিদের বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী, ইমদাদ হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক বা মুর্তজা বশীরের কাজে আমরা দেখি বা এর আগের প্রজন্মে জয়নুল আবেদীন কিংবা এসএম সুলতানের হাতে সেই সম্ভাবনাগুলো তৈরি হচ্ছিল। বাংলার নিজস্ব শিল্প পরিচয় নির্মাণে তাদের সবার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ওই সময় যথাক্রমে ১৯৫৬ ১৯৬০ সালে স্পেন ফ্রান্সে প্রশিক্ষণের জন্য বৃত্তি পান রশিদ চৌধুরী। মাদ্রিদে সেন্ট্রাল এস্কুয়েলা দে বেলাস আর্টেস দে সান ফার্নান্দোতে ভাস্কর্য বিষয়ে পড়াশোনা করেন। প্যারিসে একাডেমি জুলিয়ানে ভাস্কর্য, ফ্রেস্কো ট্যাপেস্ট্রিতে মনোনিবেশ করেন।

ইউরোপে প্রথম সফরে মার্ক শাগালের চিত্রকর্ম দ্বারা প্রভাবিত হন রশিদ চৌধুরী। তখন তার বেশির ভাগ চিত্রকর্মের বিষয় ছিল গ্রামীণ দৈনন্দিন জীবন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। পরে আধুনিক ট্যাপেস্ট্রির জনক জঁ ল্যুর্সার অধীনে প্যারিসে প্রশিক্ষণ তরুণ রশিদ চৌধুরীর সামনে নতুন দিকচক্রবলয় খুলে দেয়। শাগালের প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। তবে তার বাঙালি মেজাজ ল্যুর্সার দিকেই ঝোঁকে। আধুনিকতায় মনুষ্যত্বের উপস্থিতি, রহস্যবাদ, শিল্পগুরুদের স্মৃতিচারণের সঙ্গে এসেছে বাংলার নিজস্ব অর্জন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা।

১৯৬৫ সালের দিকে ট্যাপেস্ট্রিতে আত্মপ্রকাশ করেন রশিদ চৌধুরী। কেন মাধ্যম বেছে নিলেন, সে প্রসঙ্গে পরবর্তী সমেয় তিনি বলেন, আমার কল্পনায় একটি প্রজাপতি বাতাসে উড়বে। আমি সাধারণত তেল জলরঙে সন্তুষ্ট বোধ করিনি। যেহেতু পিয়ানো অর্গান চমৎকার বাদ্যযন্ত্র, কিন্তু একক পারফরম্যান্সের জন্য খুব বেশি কার্যকর নয়, শিল্পের ক্ষেত্রেও সাধারণ মাধ্যম রয়েছে যার সীমাবদ্ধতা। তাই এমন একটি মাধ্যম খুঁজছিলাম, যার মাধ্যমে আমার মাতৃভূমির পুরুষ প্রকৃতিকে উপযুক্তভাবে চিত্রিত করতে পারি। আমার অনুসন্ধান অবশেষে ফল দিয়েছে। আমি ট্যাপেস্ট্রিতে আমার গন্তব্য খুঁজে পেয়েছি।

তবে ট্যাপেস্ট্রি প্রসঙ্গে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির পর্যালোচনা রয়েছে তার। অন্যদের আলোচনার জবাবে দেশীয় থাকতে চান রশিদ চৌধুরী। বলেন, শিল্প কখনো মাধ্যম বা উপকরণসর্বস্ব হওয়া উচিত নয়। যখন যা সুলভ তা- শিল্পের উপকরণ হতে পারে। আমি যখন প্রথম ট্যাপেস্ট্রি করতে শুরু করি, অনেকেই এর ভেতর পাশ্চাত্য রীতি আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ উপকরণ, এর বুনন পদ্ধতিও যেমনপট, চট পুরোপুরি আমাদের দেশীয়।

একান্ত শিল্প অভিমুখ খুঁজে পাওয়ার পর ১৯৬৫ সালেই বাংলাদেশে ফেরেন রশিদ চৌধুরী। ঢাকা আর্ট কলেজে প্রাচ্যকলা বিভাগের প্রথম শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। পরে ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে যোগ দেন। তার হাত ধরেই বিভাগে বিকাশ ঘটে। একক, যৌথ, জাতীয় আন্তর্জাতিক অনেক প্রদর্শনীতে রশিদ চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন। তার শিল্পকর্ম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নামি সব গ্যালারি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়। সম্প্রতি তার একটি শিল্পকর্ম ঠাঁই পেয়েছে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ট্যাপেস্ট্রি হলো ষড়ঋতু (১৯৬৭), রোমান্স (১৯৭০), জাদুঘর (১৯৭০), সোনাভানু (১৯৭০), আমার সোনার বাংলা (১৯৭৫), আদম (১৯৮২), কালবৈশাখী (১৯৮৫) ইত্যাদি। তবে আবারো স্মরণ করিয়ে দেয়া যাক, রশিদ চৌধুরী কখনো অন্য ফর্মগুলো পুরোপুরি ত্যাগ করেননি। কিছু ট্যাপেস্ট্রিতে বেছে নিয়েছিলেন মিশ্র মাধ্যম।

শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে একুশে পদক এবং ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার পান রশিদ চৌধুরী। এর আগে ১৯৭১ সালে প্রত্যাখ্যান করেন পাকিস্তান সরকারে দেয়া পুরস্কার। ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

রশিদ চৌধুরীর শিল্পকর্মে সুস্থির মোলায়েম ঔজ্জ্বল্য লক্ষ করা যায়। কালো, লাল, সবুজ, আকাশি, সাদা, বাদামি আবহে ফুটিয়ে তোলেন গাছপালা, ফুল উদ্ভিদসহ বিভিন্ন জৈব ফর্ম, যার জ্যামিতিক বিন্যাস বিশ্বজনীনতা তৈরি করে; যেখানে প্রেমময় মানুষ প্রকৃতি চিনতে ভুল হয় না। ট্যাপেস্ট্রির পাশাপাশি তেলরঙ, টেম্পেরা, গুয়াশ, জলরঙ ইত্যাদি মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। জীবনের শেষ বছরে ক্যালিগ্রাফিও করেছেন।

শিল্পের ইতিহাস থেকে মাধ্যমকে কখনো আলাদা করে দেখেননি রশিদ চৌধুরী। এর মধ্যে শুধু যুগের পরিবর্তনই নয়, যুগ পরিবর্তনের বিপ্লবকেও শিল্পীরা এগিয়ে দেন। সমাজের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক রূপান্তর এর সঙ্গে ভীষণভাবে যুক্ত। এখানে ভীষণভাবে মতাদর্শিক হয়ে ওঠেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, পাশ্চাত্যের শিল্প-সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। অতীতে শিল্প ছিল পুরোপুরি সামন্তবাদের অধীনে, প্রভাব ছিল সামন্তবাদের। এরপর ক্রমাগত রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীরাও বিদ্রোহ করেছেন প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে, শিল্পী ক্রমেই মতবাদের যুগে প্রবেশ করেছেন। এভাবে বিদ্রোহের ভেতর দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে মহৎ শিল্প।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫