বিশ্লেষণ

মূল্যবৃদ্ধির কারসাজি শেষ হবে কবে

প্রকাশ: নভেম্বর ২৮, ২০২২

ড. শহীদুল জাহীদ

প্রচলিত অর্থনীতির তত্ত্বানুযায়ী যেসব দ্রব্য সেবাসামগ্রীর বাজার চাহিদা আছে সেসব দ্রব্য সেবাসামগ্রীর উৎপাদন হবেই হবে। চাহিদা আছে অথচ জোগান নেই ধরনের পণ্য সেবা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বলতে গেলে কী উৎপাদন হবে, কতটুকু উৎপাদন হবে, কীভাবে বা কোন পদ্ধতিতে উৎপাদন হবে এবং উৎপাদিত পণ্য সেবাসামগ্রী কাদের মাঝে কীভাবে বণ্টন হবেএসবই হচ্ছে আধুনিক অর্থনীতির মৌলিক প্রশ্নমালা। কী উৎপাদন হবে এবং তা কতটুকু উৎপাদন হবে দুই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে উৎপাদনের উপকরণের সহজলভ্যতার ওপর। উৎপাদনের মৌলিক উপাদান দুটি, যথা মূলধন শ্রম। অর্থাৎ মূলধন এবং শ্রমের যথাযথ সংমিশ্রণে যেকোনো পণ্য সেবা উৎপাদন সম্ভব। শুধু মূলধন অথবা শুধু শ্রমের মাধ্যমে কোনো কিছুই উৎপাদন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে শ্রমের সহজলভ্যতা রয়েছে কিন্তু মূলধন দুষ্প্রাপ্য বিধায় মূলধনসামগ্রী আমদানি করতে হয়। আবার নব্য ধনী মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে মূলধন সহজলভ্য হলেও শ্রম বা শ্রমিকের ঘাটতি থাকায় তারা বাংলাদেশ, ভারত প্রভৃতি দেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করে।

অর্থনীতির চতুর্থ মৌলিক প্রশ্ন তথা উৎপাদিত সামগ্রী কাদের মাঝে কীভাবে বণ্টন হবে তা নির্ভর করে প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার ওপর। কালের বিবর্তনে বিশ্বব্যবস্থায় বিভিন্ন বাজার ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। আধুনিক কালে প্রসিদ্ধ বাজার ব্যবস্থাকে মূলত দুভাগে ভাগ করা হয়, যথা নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা মুক্তবাজার ব্যবস্থা। দুইয়ের সংমিশ্রণে মিশ্র বাজার ব্যবস্থা বলে এক ধরনের বাজার ব্যবস্থাও বিশ্বের কোনো কোনো প্রান্তের কোনো কোনো দেশে প্রচলিত আছে। নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় সরকারি কাঠামোর মাধ্যমে উৎপাদনের উপকরণগুলো এবং তার মালিকানা নির্ধারিত হয়। সেক্ষেত্রে সাধারণ উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা সাধারণের তেমন কিছুই বলার থাকে না। নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে সবাই সমান, সবার জন্য গণ পণ্য ইত্যাদি স্লোগানে বিশ্বাসী বিধায় মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রভাব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উপস্থিত থাকে।

বিশ্বায়নের যুগে মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়যাত্রা চলছে। দেশে দেশে সরকার রাষ্ট্রীয় কাঠামো তো বটেই, সাধারণ জনগণও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মুক্তবাজার অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অদৃশ্য হাত-এর ইশারায় কোনো পণ্য সেবাসামগ্রী উৎপাদিত হয় এবং লেনদেনকৃত পণ্য সেবার বাজারমূল্য নির্ধারণ হয়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তার অ্যান ইনকোয়ারি ইনটু দ্য ন্যাচার অ্যান্ড কজেস অব দ্য ওয়েলথ অব ন্যাশনস (১৭৭৬) গ্রন্থে দ্য লেইসেজ ফেয়ার ধারণার কথা উল্লেখ করেন। দ্য লেইসেজ ফেয়ার বাজার ব্যবস্থাই মূলত মুক্তবাজার অর্থনীতি ব্যবস্থার অঙ্কুরোদ্গম ঘটায়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতকরণ, বহু ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি এবং মূল্যনির্ধারণে চাহিদা জোগান তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব থাকে। এক্ষেত্রে বাজার বলতে সুনির্দিষ্ট কোনো স্থান-কাল না বুঝিয়ে চাহিদা জোগানের উপস্থিতিকেই বোঝানো হয়।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা কীরূপ? বাংলাদেশ কি নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা না মুক্ত বাজার ব্যবস্থা বিশ্বাস করে? তাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে নিজেকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিচয় প্রদান করে। ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশগুলো যথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। এসব দেশের সঙ্গে বাজার ঘনিষ্ঠ বিধায় এসব দেশ অথবা এসব দেশের নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন বিশ্বব্যাংক বা আইবিআরডি, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে দেশের সহজ প্রবেশাধিকার রয়েছে এবং সময়ে সময়ে মূলধন ঋণ নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সমাজ, শিক্ষা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাও এসব দেশের আদলে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় রয়েছে।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা কি মুক্তবাজার ব্যবস্থা থেকে ব্যত্যয় ঘটিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে? আর তা- যদি না হবে, তবে দেশে এমনকি প্রচলিত পণ্য সেবার মূল্যনির্ধারণে এত এত নিয়ন্ত্রণ, সিন্ডিকেটর উপস্থিতি, কারসাজির উপস্থিতি কোন যুক্তিতে? করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে রয়েছে। করোনার সুস্পষ্ট অভিঘাত পদে পদে আঘাত হানবে তা অনুমিতই ছিল। বিশ্বের কোনো কোনো দেশ করোনার বিরূপ অভিঘাতের কথা মাথায় রেখে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। উৎপাদনের প্রাথমিক উপকরণ তথা জালানি তেলের সরবরাহ চেইন ব্যাহত হয়। রাশিয়ার তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আসায় বিশ্ব সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ে। ইউরোপসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলো স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে তেল গ্যাস কিনে নেয় এবং বাংলাদেশসহ কম আয়ের দেশগুলো জ্বালানি তেল, গ্যাস কিনতে হিমশিম খায়। এসব দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সরবরাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার জালানি তেল-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিদ্যুিনর্ভর রফতানি শিল্পে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপরন্তু দেশের রফতানি পণ্যের প্রধান দেশগুলোয় উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে বাজার হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়।

রফতানি পণ্যের বাজারে এরূপ বিরূপ পরিস্থিতি বাস্তবসম্মত হলেও বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের বাজার এবং দেশীয় আমদানীকৃত পণ্যের মূল্যনির্ধারণ যেন অর্থনীতির কোনো সূত্রেই মেলে না। এই যেমন দেশের বাজারে মুরগির ডিমের মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমজীবী, নিম্ন নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের কাছে মুরগির ডিমই হলো প্রাণিজ আমিষের মূল জোগানদার। এসব শ্রেণী-পেশার মানুষ মাছ-মাংসের মতো উচ্চমূল্যের পণ্য থেকে নিজেদের বিরত রাখতে বাধ্য হয়। অথচ বাংলাদেশে ডিমের বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এরূপ সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে যে বাংলাদেশের কিছু আমদানিকারক পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে কয়েক কোটি ডিম আমদানি করতে চায়। আমদানির জন্য তারা এরই মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছে। মন্ত্রণালয়ও শিগগিরই বৈঠক ডেকে বিষয়ে মতামত দেবে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, ডিম আমদানির প্রক্রিয়ায় দেশীয় মুরগির খামারিরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কারণ ডিম আমদানির অনুমতি দিলে দেশীয় খামারিদের স্বার্থে আঘাত আসবে। বর্তমানে বাংলাদেশে ফার্মের মুরগির লাল ডিমের মূল্য হালিপ্রতি ৫০-৫৫ টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি ডিমের বাজারমূল্য ১২-১৩ টাকা। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সমজাতীয় মুরগির ডিম প্রতি পিস মাত্র টাকা ৫০ পয়সা। আমদানির অনুমতি মিললে তারা দেশে প্রতিটি ডিম টাকায় সরবরাহ করতে পারবে অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের বাজার দাম পড়বে টাকা। খবরে দেশের মুরগির খামারিরা আমদানি ঠেকাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কারণ তারা মুরগির ডিম দিয়ে সাধারণ জনগণের পকেট থেকে দেদার উচ্চমূল্য হাতিয়ে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু মুরগির ডিম নয়, মাংসের বাজারও বাংলাদেশে তুলনামূলক চড়া। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই গরুর মাংসের দাম সর্বোচ্চ। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপে যেখানে গরুর মাংসের গড় দাম কেজিপ্রতি ৫০০ টাকার নিচে, সেখানে বাংলাদেশে গরুর মাংসের কেজিপ্রতি গড় দাম ৭০০ টাকার মতো। ক্রয়ক্ষমতার সমতার কথা ধরলে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম উন্নত দেশের বাজারের চেয়েও বেশি। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে এক কেজি হালাল গরুর মাংসের দাম প্রায় হাজার জাপানিজ ইয়েন যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় হাজার ৬০০ টাকার মতো। জাপানিজদের বার্ষিক গড় আয় বাংলাদেশীদের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি। সে অর্থে বাংলাদেশে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৭০০ টাকা হলে জাপানে হওয়া উচিত প্রায় ২১ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানে মাত্র হাজার ৬০০ টাকায় এক কেজি গরুর মাংসের পাওয়া যায়। সে অর্থে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম জাপানের চেয়ে ঢের বেশি। প্রতি বছর রোজার মাস এলে দেশের মাংস ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে গরুর মাংসের দাম বাড়িয়ে দেন। কিছু কিছু আমদানিকারক গরুর মাংস আমদানির কথা বললে দেশীয় মাংস ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট ডেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে আমদানি প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে দেন। একপর্যায়ে বর্ধিত দামই জনগণ মেনে নিতে বাধ্য হয়। সরকারি সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রে দেনদরবার করলেও পরে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

দেশের বাজারে আমদানীকৃত পণ্যের ক্ষেত্রেও এরূপ মূল্য কারসাজি ঘটে। আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেলের বাজারই হোক অথবা রড সিমেন্টের মতো পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেই হোক, এরূপ কারসাজি থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। নিকট অতীতে আমরা এও দেখেছি, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে আগে আমদানি করা সয়াবিন তেল বর্ধিত মূল্যে দেশের বাজারে বিক্রয় করা হয়েছে। কোনো কোনো সময় এসব সিন্ডিকেট এমন তেলেসমাতি দেখান যে পুরো বাজার থেকে পণ্য গায়েব করে ফেলতে পারেন। নিকট অতীতে সয়াবিন তেল, আটা, চিনি, ডিম ইত্যাদি প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রে ধরনের কারসাজি দেশবাসী অবলোকন করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন মূল্য কমে যায়, তখন তারা মূল্য কমানোর কথা বেমালুম ভুলে যান।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শুধু আমদানি করা পণ্যেই নয়, দেশীয় বাজারেও মূল্য সিন্ডিকেটের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। এসব সিন্ডিকেট কখনো বিদেশে মূল্যবৃদ্ধি, কখনো যুদ্ধ, কখনোবা দেশীয় কোনো আচার-অনুষ্ঠান, ঈদ, পূজা-পার্বণ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে। উৎপাদিত পণ্যের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির মতো যৌক্তিক কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতেই পারে। ভোক্তা সাধারণ সে মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুতও থাকে। কিন্তু অবাধ তথ্যপ্রবাহের অধিকার কুক্ষিগত করে, ধর্মঘট, কর্মবিরতি, সরকারের ওপর অযৌক্তিক চাপ তৈরি করে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এবং সর্বোপরি জনগণের চাহিদাকে জিম্মি করে মুক্তবাজার অর্থনীতির বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় সিন্ডিকেটের কারসাজির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কাম্য নয়।

 

. শহীদুল জাহীদ: অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫