যশোরের জনসভায় শেখ হাসিনা

জনগণ সুযোগ দিলে আগামী দিনে আরো উন্নয়ন করব

প্রকাশ: নভেম্বর ২৫, ২০২২

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, যশোর

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর খানেক বাকি থাকলেও যশোর থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাসীন দলকে আবারো ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে যশোরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, দেশের অনেক উন্নয়ন করেছি; আপনারা সুযোগ দিলে আগামী দিনে আরো করব। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আগামীতেও ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন কিনা ওয়াদা চাই। আপনারা হাত তুলে ওয়াদা করেন। যশোর শামস-উল হুদা স্টেডিয়ামে গতকাল বিকালে আওয়ামী লীগের জনসভায় তিনি কথা বলেন। ৩৫ মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দেশের নানা উন্নয়নচিত্র, অতীত বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

রিজার্ভ নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে নানা সমালোচনা করছে, রিজার্ভ কোথায় গেল সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। আমরা তো অপচয় করিনি। মানুষের কল্যাণে কাজে লাগিয়েছি। জ্বালানি তেল কিনতে হয়েছে, খাদ্যশস্য কিনেছি। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। করোনার টিকা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেছি। এসব কাজে রিজার্ভ থেকে খরচ করতে হয়েছে। কারণ আমরা সবসময় মানুষের কথা চিন্তা করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। তবে পর্যাপ্ত রিজার্ভ হাতে রেখেই সব কাজ করছি আমরা। কোনো সমস্যা নেই, আমাদের সব ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা আছে। সামনের দিনেও কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের সরকার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়েছে। আর কোনো সরকার বাড়াতে পারেনি।

কোনো মানুষ ভূমিহীন থাকবে না, ঠিকানাহীন থাকবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসি, তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিই একটি মানুষও ভূমিহীন থাকবে না। এবার আমরা ক্ষমতায় এসে ভূমিহীনদের ঘর তৈরি করে দিয়েছি। ৩৫ লাখ মানুষকে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছি। ঘর পেয়ে ওইসব মানুষের জীবন পাল্টে গিয়েছে। জাতির পিতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছি।

যশোরে জনসভা করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী অনেক আনন্দিত উল্লেখ করে বলেন, এই যশোরে আমার নাড়ির টান আছে। এখানকার মাটিতে আমার নানা শেখ জহুরুল হক শুয়ে আছেন। তিনি যশোরে চাকরি করতেন। আমার মায়ের বয়স যখন তিন বছর ছিল তখন তিনি মারা যান। ওই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই খারাপ ছিল যে মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া যায়নি। তাই নানাকে এখানে দাফন করা হয়েছে। ওনার স্মরণে এখানে দারিদ্র্য বিমোচন ট্রেনিং সেন্টারও হচ্ছে।

মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে বিএনপি নিজেদের উন্নয়ন করেছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, রক্ত আর হত্যা ছাড়া বিএনপি কিছু দিতে পারেনি। তারা কিছুই দিতে পারে না, শুধু পারে মানুষের রক্ত চুষে খেতে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। বিচার পাওয়ার অধিকার আমার ছিল না। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে হারিয়েছি। তার পরও বাংলায় ফিরে এসেছি। বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমার লক্ষ্য। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। একের পর এক ক্যু হয়েছে। এর সঙ্গে জিয়া-মোশতাক সবাই জড়িত। তারা সবাই খুনি। আমি বিচার চাইতে পারিনি। তার পরও সবকিছু মাথায় নিয়ে ফিরে আসার একটাই কারণ, জাতির জন্য আমার পিতা সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। সেজন্য আমার লক্ষ্য ছিল, দেশের মানুষের জন্য কিছু করা। বারবার ক্ষমতায় এসেছি বলেই উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক করেছে, যেখানে বিনাপয়সায় ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। বিএনপি দিয়েছে অস্ত্র, খুন, হত্যা। শুধু হত্যা আর খুন ছাড়া কিছু দিতে পারেনি তারা। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আজকে তারেক জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। সেজন্য তার সাজা হয়েছে। অস্ত্র চোরাকারবারি করতে গিয়ে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা খেয়েছে, সেখানেও তার সাজা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমিসহ নেতাকর্মীদের হত্যা করতে চেয়েছে। খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে আজ সাজাপ্রাপ্ত। আর সাজাপ্রাপ্ত নেতা জনগণকে কী দেবে, সেটাই আমার প্রশ্ন। তারা কিছুই দিতে পারে না, শুধু রক্ত চুষে খেতে পারে।

সরকারপ্রধান বলেন, যশোরে উন্নয়নে কিছুই করেনি বিএনপি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে করেছে। আওয়ামী লীগ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু থেকে যেন সহজেই যশোরে আসা যায় সে রেললাইনের কাজ চলছে। গত জাতীয় নির্বাচনে যশোরের সবকটি আসনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করায় যশোরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। সেখানে যুবকদের অনেক কর্মসংস্থান হবে। যুবকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কর্মসংস্থান ব্যাংক করে দিয়েছি। সেখান থেকে বিনাজামানতে লাখ টাকা ঋণ পাওয়া যায়। এটা নিয়ে নিজেরাই ব্যবসা করতে পারবে যুবকরা। এখনকার যুগে কেউ আর বেকার থাকবে না। কিছু না কিছু করতে পারবে। সেই সুযোগটা আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো দেশ করোনার টিকা বিনাপয়সায় দেয়নি। আমি দিয়েছি। করোনা মোকাবেলার জন্য বিশেষ বিমান পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সামগ্রী এনেছি। রিজার্ভ মানুষের কাজে লেগেছে। যে গম ২০০ ডলারে কিনতাম, তা এখন ৬০০ ডলার। যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিস্থিতি। তার পরও আমরা কিনে এনেছি, যাতে খাদ্য ঘাটতি দেখা না দেয়। এজন্য আমি জমি অনাবাদি না রেখে উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী আবারো সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, কারো জমি যেন অনাবাদি না থাকে। প্রত্যেকটা জমি আবাদ করতে হবে, যাতে আমাদের খাদ্য ঘাটতি না হয়। কারো কাছে হাত পাততে না হয়, কারো কাছে চেয়ে চলতে না হয়, যার কাছে যা আছে তা দিয়ে কিছু উৎপাদন করুন।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না বলে জাতির পিতা যে প্রকল্প শুরু করেছিলেন, তার সেই পথ ধরে সারা দেশে গৃহহীনদের তালিকা করা হয়েছে। বিনাপয়সায় জমিসহ তাদের ঘর করে দিয়েছি। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ ঘর পেয়েছে, যাদের কোনো ঠিকানাই ছিল না। এটা তাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে। দেশের কোনো মানুষ ঠিকানাবিহীন থাকবে না। যে বাংলাদেশ খালেদা জিয়া রেখে গিয়েছিলেন, ৪০ ভাগ দারিদ্র্যের হার, এটা আমরা ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। যে হতদরিদ্র ২৫ ভাগ ছিল, তা আমরা ১০ ভাগে নামিয়ে এনেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যশোরে ভবদহ জলাবদ্ধতা দূর করার প্রকল্প শেষ হয়েছে। এবার আমরা দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ফলে যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা দূর হবে। ৮২ কিলোমিটার নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কাজ হাতে নিয়েছি। কপোতাক্ষের মতো ভবদহের জলাবদ্ধতা যেন না থাকে সে বিষয়েও আমরা পদক্ষেপ নেব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরের শামস-উল হুদা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জনসভা মঞ্চে আসেন বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে। মঞ্চে উঠে তিনি হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানান। সময় উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মীদের স্লোগানে গোটা এলাকা মুখর হয়ে ওঠে। যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের সভাপতিত্বে দুপুর সাড়ে ১২টায় সমাবেশ শুরু হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য . আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বাগেরহাট- আসনের সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন প্রমুখ।

এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একাডেমির রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ (শীতকালীন) ২০২২- ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কভিড-১৯ মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিষেধাজ্ঞার ফলে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে গেলেও দেশের অর্থনীতি এখনো যথেষ্ট গতিশীল নিরাপদ। সরকার বৈশ্বিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে অত্যন্ত সজাগ সক্রিয়। দেশপ্রেম, আন্তরিকতা, জনগণের আস্থা বিশ্বাস অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরে দেশ জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা মাথায় রেখে বিমান বাহিনীর নবীন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অনেক দেশ যখন দুর্ঘটনা, দুর্বিপাকে পড়ে, আমরা কিন্তু তাদের সহযোগিতা করি। আবার আমাদের দেশে যখন ঝড়, বন্যা বা কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটে বিমান বাহিনীর সদস্যসহ সশস্ত্র বাহিনীর সবাই জনগণের পাশে দাঁড়ায়, জনগণের সেবা করে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনগণের আস্থা বিশ্বাস অর্জনে। যেকোনো একটা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য এটা একান্তভাবে দরকার।

ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে যশোরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল সাড়ে ১০টায় যশোর বিমান বাহিনী একাডেমির প্যারেড গ্রাউন্ডে হেলিকপ্টারটি অবতরণ করলে বাহিনীপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। সেই সঙ্গে সশস্ত্র সালাম জানান বিমান বাহিনীর চৌকস সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী খোলা জিপে করে প্যারেড পরিদর্শন সালাম গ্রহণ করেন। পরে তিনি সেরা ক্যাডেটদের হাতে সোর্ড অব অনার, চিফ অব এয়ার স্টাফ ট্রফি কমান্ড্যান্টস ট্রফি তুলে দেন। নির্বাচিত ক্যাডেটদের পরিয়ে দেন ফ্লাইং ব্যাজ এবং বিভিন্ন সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননায় ভূষিত করেন।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫